হিমবাহের মৃত্যু এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ
অনিন্দ্য পাল
সম্প্রতি ইউরোপের দ্বীপ রাষ্ট্র আইসল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে অনুষ্ঠিত হল একটা অদ্ভুত অনুষ্ঠান। মানুষের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করা হয় একথা সবার জানা, এমনকি জন্তু জানোয়ারদের জন্যও এমন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু কখনো কোনো হিমবাহের জন্য এমনটা করা যায় - তামাম দুনিয়ার মানুষ কখনও এমনটা ভাবেওনি, শোনেওনি। তবে এখন আর এই ঘটনা অভাবনীয় নয়। আইসল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে এই ঘটনাটি ঘটলো সমস্ত পৃথবীতে প্রথমবারের জন্য।
আর এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মানুষের অপরিণামদর্শীতার জন্য সভ্যতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
ঘটনাটা হল, আইসল্যান্ডে সদ্য একটা হিমবাহের মৃত্যু ঘটেছে, আর স্থানীয় গবেষক এবং আমেরিকার রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই মৃত্যুকে একটা মাইলফলক হিসাবে সমস্ত বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য রীতিমত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছেন, সেখানে একটা ব্রোঞ্জ ফলকের উপর সভ্যতার উদ্দেশ্যে একটা সচেতনতা মূলক বক্তব্য খোদাই করে উৎসর্গ করা হয়েছে ওই মৃত হিমবাহের নামে। ওই ফলকে উৎকীর্ণ আছে " A letter to the future ", এবং গত মে মাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ "415ppm", যা কিনা একটা রেকর্ড পরিমাণ নির্গমন।
Okjokull ( অর্থাৎ OK Glacier )নামের এই হিমবাহটা ২০১৪ সালেই হিমবাহের তকমা হারিয়ে ফেলেছিল, কারণ উপগ্রহ চিত্রে তখন থেকেই বোঝা গেছিল যে Okjokull তার বরফ শরীরের প্রায় সবটাই হারিয়ে ফেলেছে আর তার গতিময়তাও প্রায় নেই বললেই চলে। ১লা আগস্ট , ২০১৯ তারিখে উপগ্রহ চিত্র জানিয়ে দিল সে আর নেই - অর্থাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেল Okjokull হিমবাহ। কিন্তু একটা হিমবাহের মৃত্যুতে এত শোরগোল পড়ে গেল কেন? কী এমন ক্ষতি হবে তাতে! হ্যাঁ সেটাই আসলে চিন্তার বিষয়।
শুধু যদি আইসল্যান্ডের কথাই ধরা হয়, প্রতি বছর ১১০০ কোটি টন হিসেবে বরফ হারাচ্ছে এই দ্বীপ, এবং ২২০০ সালের মধ্যে আইসল্যান্ড একটা বরফশূন্য স্থলভাগে পরিণত হবে। এই দ্বীপের প্রায় ৪০০ টির ও বেশী হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ১৮৯০ সালেও যেখানে এই Okjokull ১৬ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের বরফময় হিমবাহ ছিল, ২০১২ সালে সেটাই দাঁড়িয়েছিল মাত্র ০.৭ বর্গকিলোমিটার। বিপুল হিমবাহ থেকে শীর্ণকায় একটুকরো বরফ আরকি! আসলে বিশ্ব উষ্ণায়ন এর জেরে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হিমবাহগুলো রোগা হতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠন (International Union For Conservation Of Nature) ২০১৯ এর এপ্রিলে একটা গবেষণাপত্রে জানিয়েছে, সমস্ত পৃথিবীর অন্ততঃ অর্ধেক হিমবাহ ২১০০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যদি বর্তমান হারে গ্রীনহাউস গ্যাস গুলো বাতাসে মিশতে থাকে। বর্তমানে সমস্ত পৃথবীতে ১৯৮০০০- ২০০০০০ গুলো হিমবাহ রয়েছে।
১৫৫০-১৮৫০ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর পৃথিবীতে একটা মৃদু তুষার যুগ চলছিল। এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও গবেষক মহলে বিতর্ক থাকলেও সেই সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যে বর্তমানের চেয়ে ঠাণ্ডা ছিল সে বিষয়ে খুব একটা বিতর্ক নেই। কিন্তু ১৮৫০ এর পর থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর জল-স্থল এর উষ্ণতা প্রায় ০.৭৫° সেলসিয়াস বেড়েছে। আবার ১৯৭৯ সাল থেকে স্থলভাগের তাপমাত্রা ০.২৫° সেলসিয়াস প্রতি দশকে বেড়েছে, যা কিনা জলভাগের উষ্ণতা বৃদ্ধির (০.১৩° সেলসিয়াস প্রতি দশকে) প্রায় দ্বিগুণ। এর ফলে দ্রুত গলতে শুরু করেছে বিশাল আকারের সব হিমবাহ।
নিরক্ষরেখার কাছাকাছি সমস্ত পর্বতমালা অঞ্চলের, যেমন - হিমালয়, আল্পস, রকি, দক্ষিণ আন্দিজ, ক্যাসকেড এবং ট্রপিক্যল অঞ্চলের মাউন্ট কিলিমনজারো তে এই হিমবাহের ক্ষীণতনু হতে থাকার হার সবচেয়ে বেশী।
১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্ব উষ্ণায়ন এর মাত্রা দ্রুত বেড়েছে, ফলে গ্রীণল্যন্ড, পশ্চিম আন্টর্কটিকা অঞ্চলের বরফের চাদর পাতলা হতে শুরু করেছে দ্রুত হারে। প্রথমদিকে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মেরু অঞ্চলের বরফের চাদর পাতলা হবার সঙ্গে সমুদ্রের জলতল বেড়ে ওঠার তেমন সম্পর্ক নেই, তবে সে ভুল তাদের ভেঙেছে, এখন গবেষণা দেখাচ্ছে আন্টর্কটিকা এবং গ্রীণল্যন্ড এর হিমবাহ গুলোর অতিরিক্ত গলনের ফলে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা প্রতি বছরে ০.৫ মিলিমিটার করে বেড়ে উঠেছে। এর মধ্যে আন্টর্কটিকার থয়েটস হিমবাহ গলেই সমুদ্রের জলতল প্রায় ৪% বেড়েছে, এবং এটা পুরো গললে সমুদ্রের জলের উচ্চতা অন্ততঃ ২ ফুট (প্রায় ৬৫ সেমি ) বেড়ে যাবে। গবেষণা বলছে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা অন্ততঃ ২.৬ ফুট (০.৮মিটার)বাড়বে। যদি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের সব বরফ গলে যায় তবে সমুদ্রের জলের তল অন্তত ৭০ মিটার (২৩০ ফুট প্রায়) উঁচু হয়ে যাবে, আর তখন এই
সভ্যতার সব আহ্লাদ দ্রবীভূত হবে নোনা জলে।
ভারতের অন্যতম নদী গঙ্গার উৎস গোমুখ গঙ্গোত্রী হিমবাহ। নাসা এবং আন্তর্জাতিক গবেষকদের গবেষণা এই গঙ্গোত্রী হিমবাহের রোগা হতে থাকার যে তথ্য দিয়েছেন, তা খুব ভয়ের। ১৯৩৬ থেকে ১৯৯৬ এই ৬১ বছরের তথ্য বলছে, এই সময়ে গঙ্গোত্রী হিমবাহ ১১৪৭ মিটার পিছিয়ে গেছে। প্রতি বছর গড়ে ১৯ মিটার করে পিছোচ্ছে গঙ্গোত্রী, কিন্তু গত ২৫ বছরে এই হার ভয়ানক বেড়ে গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৪ মিটার করে।
হিমবাহের এই ক্ষীণতনু হতে হতে মরে যাওয়ার ব্যপক প্রভাব পৃথিবীর বুকে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে আবার আবহাওয়ার পরিবর্তন হিমবাহের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে। এর কু প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতেই আইসল্যান্ডে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, পরিবেশ মন্ত্রী, রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার হাই কমিশনার এবং অধ্যাপক, গবেষকদের উদ্যোগে এই প্রথম হিমবাহ রক্ষার জন্য সংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল, যা সমস্ত পৃথবীকে একটা সতর্কীকরণ করলো, হতে পারে মানুষ সচেতন হয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন, গাছ কেটে ফেলার মত কাজ গুলো থেকে বিরত হবে, অবশ্য এমনটা না ও ঘটতে পারে। আর যদি এমনটাই চলতে থাকে তবে! শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া
National Geographic Magazine ( 2018)
Scientific American (2019)
______________________________________________________________________________________
অনিন্দ্য পাল
জাফরপুর, চম্পাহাটিি
সোনারপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন