বাঙালির চির মনন সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ
পাভেল আমান
বাঙালি জাতিসত্তার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ দেশ রাষ্ট্র গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্বের অবতারে অবতীর্ণ। বাঙালি চেতনায় জাগরণে প্রাত্যহিকতায় ছেয়ে আছে বহুমুখীন রবীন্দ্রনাথ।বাঙালি মানসে ২৫শে বৈশাখ যেমনভাবে স্মরণীয় ঠিক তার বিপ্রতীপে২২শে শ্রাবণ যেন অবিরাম বর্ষণ ধারায় সমস্ত দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা কে বিরহ বেদনাকে মুছে দিয়ে রাবীন্দ্রিক ভাবনা চেতনা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, মননশীল ও চিরায়ত হয়ে উঠেছে। ২২শে শ্রাবণ শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস নয় আপামর বাঙালির প্রাণের ঠাকুর, কাছের মানুষ, সুখে দুখের চিরসঙ্গী রবি ঠাকুরের মহাপ্রস্থান পর্ব। তিনি বাঙালি জাতি সত্তার এক বিশ্বজনীন, সর্বকালীন, সর্বজনবিদিত প্রতিভূ। বাংলা ভাষা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সনাতন ধারণা, লোকায়ত বিশ্বাস সবকিছুতেই তিনি যেন ভাসিয়ে দিয়েছেন আপন সৃষ্টিশীলতার ভুবন ডিঙ্গা। সর্বোপরি বাঙালি সাহিত্যকে ঠাঁই করে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে। বাংলা সাহিত্য যেন বিকশিত, প্রাণবন্ত, উজ্জীবিত রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল একজন কবি কিংবা সাহিত্যিকই নন, তিনি ছিলেন চিন্তাশীল এবং মানবপ্রেমিক যুগন্ধর পুরুষ। তাঁর আবির্ভাবের কাল ছিল ভারতবর্ষের ক্রান্তিকাল। সমাজব্যবস্থা ছিল নানাবিধ অনাচার-অবিচার এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, দেশবাসীর জীবন ছিল পরাধীনতার জটাজালে বন্দি আর বিশ্বাবাসীর জীবন ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হিংস্র থাবায় পর্যুদস্ত। বিপদসঙ্কুল মানব জাতির মর্মবেদনা তাঁর চিত্ত-মননকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। ফলে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মানুষের চিরন্তন অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ যেমন তিনি ঘটিয়েছেন, তেমনি সেগুলোর মাধ্যমে হতাশাদীর্ণ মানুষকে শুনিয়েছেন আশার বাণী, বিপর্যস্ত মানুষকে যুগিয়েছেন সামনে চলার প্রেরণা ও শক্তি। সমকালের মতো বর্তমান কালের সঙ্কটপূর্ণ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাচেতনা মানুষকে সম্বুদ্ধ করে জটিল ও সমস্যাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। বাঙালি এখনো বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পাই ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস লাভ করে রবীন্দ্র দর্শন ও সৃষ্টিশীলতা থেকে। বাঙালি এখনো আত্মশ্লাঘা সম্মানিত অনুভব করে চিরতরে রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে। প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ক্ষণেই সুখে-দুখে ঘাত প্রতিঘাতে জীবনের পথ চালাতে তিনি এখনো চরমভাবে প্রাসঙ্গিক। মহাকালের চেনা পথ ধরে প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণ আসে। এই বাইশে শ্রাবণ বিশ্বব্যাপী রবিভক্তদের কাছে এদিনটি শোকের, শূন্যতার। রবীন্দ্র কাব্যসাহিত্যের বিশাল একটি অংশে যে পরমার্থের সন্ধান করেছিলেন সেই পরমার্থের সাথে তিনি লীন হয়েছিলেন এদিন।৮০ বছর বয়সে চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ মৃত্যু দেহান্তর মাত্র। যত দিন যাচ্ছে, তত তিনি উজ্জ্বল হচ্ছেন। প্রাসঙ্গিক হচ্ছেন মানুষের জীবনে, মননে। প্রবল অনুরাগ ও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার আসনে বাঙালির প্রাণে তাঁর অধিষ্ঠান। সুখে ও সংগ্রামে, বেদনা-দহনে—সর্বত্র তিনি! তাঁর সৃষ্টি দিয়ে বাঙালির স্বদেশ ও সংস্কৃতির স্বরূপ-দর্শন; তাঁর চোখ দিয়েই বাঙালির বিশ্ববীক্ষা। বিপুল তাঁর রচনা, বিচিত্র তাঁর বিষয়। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই ফলেছে রাশি রাশি সোনা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র, সমালোচনা, চিত্রকলা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর অনন্য সৃষ্টিতে।পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব আর বাইশে শ্রাবণ তাঁর প্রয়াণ। আবির্ভাব আর তিরোভাব — এই দুয়ের মাঝেই সত্তার বিকাশ ও পূর্ণতা। জন্ম ও মৃত্যু, সূচনা এবং পরিসমাপ্তি — দুইই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মৃত্যুকে কবি তাই বলেছেন — 'জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা'। তাঁর জীবনব্যাপী সৃষ্টি শৈলীর সাধনার মধ্য দিয়ে এই চিরসত্যই প্রকাশ পেয়েছে বারবার। রবীন্দ্র প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ আমাদের কাছে নিয়তই এক পরম বিস্ময়ের। সাহিত্য, কবিতা চলে জীবন নিয়ে, সেই সঙ্গে মৃত্যুর ছায়া চলে তাঁর সঙ্গী হয়ে। কবির সাহিত্য কর্মের অতি প্রশস্ত আঙিনায় শোক দু:খ ও মৃত্যুচিন্তা নিয়ে বিভিন্ন লেখা দেখতে পাই।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জীবনে সাহিত্যের এমন বিচিত্র বিশ্ব রচনা করেছেন, যা বাংলা ভাষাকে শুধু বিশ্বসাহিত্যের আসরে মহিমান্বিতই করেনি, সমৃদ্ধও করেছে নানাভাবে। আজকে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতার বাণী এবং তাঁর মতাদর্শ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। রবীন্দ্রচর্চা তরুণ সমাজকে করে তুলতে পারে মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী। প্রতিবারের মতন আমরা আবার একবার সেই পুণ্য 'সাগর সঙ্গমে' এসে দাঁড়িয়েছি। বাইশে শ্রাবণ – জীবনের তাৎপর্যকে চেনায় নতুন করে।জীবন ও মৃত্যু দুটি পর্যায়। তাই মৃত্যু জীবনের শেষ নয়। মহাকালের ধারায় এ কেবলই একটা রূপান্তর মাত্র। সেকারণে দুঃখ, মৃত্যু, বিরহ ও বিচ্ছেদ – এ সব কিছুর মধ্যে প্রাণের গতিময় ছন্দকে বিশ্বপথিক মানব-সন্ধানী রবীন্দ্রনাথ স্থান দিয়েছেন সবার উপরে।তিনি নিজে ছিলেন দীর্ঘায়ু। কিন্তু একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁর সারা জীবনে ছায়া ফেলেছে।রবীন্দ্রনাথের মতন ব্যক্তিত্বই সহজেই বলতে পারেন, "মরণকে মোর দোসর করে/ রেখে গেছ আমার ঘরে/ আমি তারে বরণ করে রাখব পরাণময়।" আজকে চারিদিকে যখন ধর্ম নিয়ে হানাহানি হিংসা-বিদ্বেষ বিভাজন নিদারুণ অস্থিরতা সর্বোপরি মানবতার বিপর্যয় ঠিক সেই মুহূর্তে মনুষ্যত্বের জাগরণে মানবতার ঐক্যবদ্ধ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বড্ড প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বিভেদগামী শক্তিকে পরাস্ত করতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে চুরমার করতে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে মানবতার আহবানে সাড়া দিয়ে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সংহতি সৌহার্দ্য সম্প্রীতির শাশ্বত বাঁধনে ঐক্যবদ্ধ করতে মানব প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের জীবন চর্চা কালজয়ী সৃষ্টির ভূমিকা অপরিসীম। শুধুমাত্র জন্ম ও প্রয়াণ দিবসেই তাকে স্মরণ নয় সারা বছর মননের সংকীর্ণতা দূর করতে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে সর্বোপরি মননকে বিকশিত যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত ও মানবিক করে তুলতে রবীন্দ্র চর্চা ও তার দেখানো পথ অনুসরণ একান্ত ভাবে কার্যকরী। এ কথা আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যক্ত করতে পারি বাঙালি জাতি যদি রবীন্দ্রনাথকে পুরোদস্তুর আত্তীকরণ করতে পারে তাহলে নিশ্চিত বাঙালির আবার পুনরুজ্জীবিত হবে। স্বপ্ন দেখি বাঙালি আবার ফিরে পাবে সেই পূর্বের গৌরব সম্মান। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত, তিনি বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভার অফুরন্ত সৃষ্টিপ্রাচুর্যের দান হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দেখায় আলোর পথ।তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। তিনি বলেছিলেন – 'আমি তোমাদেরই লোক'। সকল প্রকার সুখে-দুঃখে-সন্তাপে মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক হয়ে থাকবেন।৮৩ তম প্রয়াণ দিবসে বিশ্বকবি প্রাণের কবি মননের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আরো বেশি স্মরণ করি। চারিদিকে যখন বাড়ছে অশান্তির অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন, ধর্মীয় বিদ্বেষ, বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঠিক সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথ, আদর্শ, মানবতা আমাদের মননে জমে থাকা সমস্ত কুসংস্কার, জাতিবিদ্বেষ, শ্রেণীবিভাজন, ধর্মীয় ভেদাভেদ, বৈষম্য, যাবতীয় শাসন, শোষণ নিপীড়ন, বঞ্চনা, অশান্তিকে দূর করে খুঁজে দিব্যি বেঁচে থাকার নতুন দিশা।সারা বছর অফুরন্ত সৃষ্টির ভান্ডারে তিনি বিরাজিত বাঙালি মানসে। তিনি সকলের প্রাণের ঠাকুর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ। তিনি অবলীলায় আপামর মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসায় হয়ে উঠেছেন বাঙালির মনন সঙ্গী।
______________________________________________________________________________________
পাভেল আমান
হরিহর পাড়া -মুর্শিদাবাদ
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন