হিন্দু শাস্ত্রে মা দুর্গা ও তার পরিবার এবং তার বাহনদের গুরুত্ব
অভিজিৎ দত্ত
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। সারা বছর ধরে ভক্তরা অপেক্ষা করে মা কবে আসবে মর্তে।এই দুর্গোৎসব নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। কেউ বলে দুর্গম বলে অসুরকে বধ করার জন্য মা এর নাম দুর্গা।আবার কেউ বলে মা দুর্গতি নাশ করে বলে তার নাম দুর্গা।পর্বে বসন্তকালে মা এর পুজো হত বলে নাম হয়েছিল বাসন্তী পূজো।পরে রাবণকে বধ করার জন্য ও মায়ের কৃপা পাবার জন্য অকালবোধন করেন শরৎকালে। তখন থেকেই মা এর পুজো শরৎকালে চালু হয়।এখন প্রশ্ন হচ্ছে মহামায়ার পুজো আমরা করি কেন? জগতে আমরা সকলেই মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন। এই মায়ার হাত থেকে মুক্তির জন্যই মহামায়ার আরাধনা করা হয়।মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব অথচ ছটি রিপুর(কাম,ক্রোধ, লোভ,অহংকার, মোহ ও পরশ্রীকাতরতা) দ্বারা চালিত। এই ছটি রিপুর হাত থেকে উদ্ধারের জন্যই মহামায়ার আরাধনা।মানুষ ধর্ম পালন করলেও ধর্মের মূল অর্থ না বোঝার জন্য আজ মানুষের এত সমস্যা।ধর্মের মূল কথা অন্তরকে পবিত্র করা।এটা না করতে পারলে ধর্ম পালন হয় না।আমরা বিভিন্ন সময় নানা কুসংস্কারের দ্বারা চালিত হয়। এইজন্য আমাদের অশেষ দুর্গতির মধ্যে পড়তে হয়।পূর্বে মহামায়ার বা মা দুর্গার আরাধনার মূল লক্ষ্যই ছিল অসত্য বা মায়ার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া।ঘুরিয়ে বললে বলা যায় সত্যের পথে চলাই ধর্ম। অথচ আজ আমরা কি করছি? যাইহোক নারী বা প্রকৃতি থেকেই আমাদের সৃষ্টি।তাই দেবী একজন নারী।নারীরা যেভাবে ঘর-বাহির সামলান অনেকটা দশ হাত দিয়েই কাজ করার সামিল। তাই দেবী দুর্গা দশভূজা।দেবী দুর্গার হাতে দশটা অস্ত্র। প্রত্যকটিরই অর্থ আছে।এই দশটি অস্ত্র হল ত্রিশূল(মহাদেব),সুদর্শন চক্র(বিষ্ণু),শঙ্খ(বরুণ),তীর(অগ্নি),ধনুক(বায়ু), বজ্র,(ইন্দ্র)ঘন্টা (হাতি),কালদন্ড(যম),জপের মালা ও কমুন্ডল(ব্রহ্মা), দিব্য কুঠার ও অলংকার (বিশ্বকর্মা)।
দেবী দুর্গার বাহন সিংহ।দেবী দুর্গার সঙ্গে থাকে তার পরিবার।দেবী দুর্গার ডান পাশে থাকে লক্ষী ও গণেশ এবং বাম পাশে থাকে সরস্বতী ও কার্তিক। এদের বাহনগুলো হল পেঁচা(লক্ষী),ইঁদুর (গণেশ),হাঁস(সরস্বতী) ও ময়ূর(কার্তিক)।প্রথমেই আসি মা দুর্গার বাহন সিংহের কথায়। সিংহ হচ্ছে পশুরাজ এবং মহাশক্তিশালী। সিংহ হচ্ছে রজোগুণের প্রকাশ। এই রজোগুণের সঙ্গে যদি সত্ত্বগুণের যোগ হয় তবেই কল্যাণ সম্ভব। মানুষ হচ্ছে বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন জীব ।এই বিবেক যদি জাগ্রত থাকে তবেই মানুষের কল্যাণ সম্ভব। সিংহের যেমন প্রচন্ড পাশবিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও মায়ের চরণে আশ্রয় নিয়েছে সেইরূপ মানুষ যদি মায়ের আশ্রয়ে যায় তবেই তার চেতনা শক্তি জাগ্রত হবে।এইবার আসবো মায়ের সঙ্গে যুক্ত অন্য দেব-দেবীর বাহনের কথায়। মায়ের ডানদিকে রয়েছেন দেবী লক্ষী।এই লক্ষী দেবী ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পরিচিত।তবে অর্থই একমাত্র ধন নয়।এর চেয়েও বড় ধন হল চরিত্র ধন।কিন্ত এটা নিয়ে অনেকেই সচেতন নয়।অর্থের অভাবে মানুষ যেমন লক্ষী ছাড়া তেমনি যার অর্থ আছে কিন্ত চরিত্র ধন নেই সে হল লক্ষীছাড়া।চরিত্র ধন না থাকলে সে সমস্ত ধনই হারাবে।তাই শুদ্ধ ও সংযত চরিত্র গঠন একান্ত প্রয়োজন। আবার লক্ষীর বাহন পেঁচা। যে রাতে জাগ্রত থাকে।পেঁচা আবার রাতে শস্য নাশকারী ইঁদুরের হাত থেকে আমাদের শস্য রক্ষা করে আমাদের মঙ্গল সাধন করে।পেঁচার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হল, সে মুক্তিকামী সাধকদের শিক্ষা দেয় সকলে যখন ঘুমায় তখন তুমি জেগো থাকে তবেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্ভব। আসলে সাধককেও পেঁচার মত লোকচক্ষুর আড়ালে সাধনা করে যেতে হবে।লক্ষীর পাশেই রয়েছে গণেশ। গণেশ যেমন সিদ্ধিদাতা তেমনি গণদেবতাও।জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ হবে তখন সকল বিঘ্ন দূর হবে।এইজন্য গণেশের আরেক নাম বিঘ্নেশ অর্থাৎ বিঘ্ননাশকারী।গণেশের বাহন ইঁদুর বা মূষিক। ইঁদুরের দাঁত এত ধারালো ও শক্তিশালী যে সে যে কোন শক্ত দড়ি বা পাথর কেটে দিতে পারে।আবার ইঁদুর এই শিক্ষাও দেয় তুমি যতই ক্ষুদ্র হও না কেন ধের্য ও নিষ্ঠা সহকারে কাজ করলে সাফল্য আসবেই।ইঁদুর হচ্ছে পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের প্রতীক। আবার আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দেখলে আমরা সকলেই মায়ার জগতে বন্ধন যুক্ত। এই বন্ধন কাটতে গেলে ইঁদুরের মত হতে হবে।না হলে আমাদের মুক্তি হবে না।ইঁদুরের দাঁত হচ্ছে আমাদের বিবেক ও বৈরাগ্য। এই দুটি জিনিসের দ্বারা আমরা বন্ধন মুক্ত হবো।দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তিনি শুদ্ধ সত্ত্বরূপী, বিদ্যাদায়িনী ও জ্ঞানদায়িনী। তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন জ্ঞান লাভ করতে গেলে সাধককে হতে হবে দেহ,মনে ,প্রাণে শুচি ও শুদ্ধ ।দেবীর বাহন হংস।হংস জলে থাকে কিন্ত জল লাগায় না।এই সংসারে অনেক পাঁক থাকবে কিন্ত হাঁসের মত হবে অর্থাৎ পাঁক লাগানো যাবে না।এখানে পাঁক হচ্ছে অবিদ্যা। এই অবিদ্যা থেকে মুক্ত হলে তবেই মানুষের পক্ষে পরম জ্ঞান লাভ সম্ভব। দেবী সরস্বতীর বাহন হংস কোন সাধারণ প্রাণী নয়।সে হচ্ছে পরম হংসের প্রতীক।জলে,স্হলে, আকাশে সবর্ত্র এর গতি।এরপরেই আসি দেবী কার্তিকের কথায়। কার্তিক হলেন দেব সেনাপতি। সৌন্দর্য, শৌর্য, বীর্যের প্রতীক। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন শৌর্য-বীর্য দেখানো প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সংসার রূপী সমরাঙ্গনে। তার জন্য মানুষকে হতে হবে কার্তিকের মত সাহসী ও বুদ্ধিমান। তবেই সংসার যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। কার্তিকের বাহন ময়ূর। ময়ূর বাহ্ম মহূর্তে জেগে উঠে। এদের আর একটা স্বভাব দলবদ্ধ থাকার। মানুষ যদি ময়ূরের মত পরিশ্রমী ও দলবদ্ধ থাকে তবে জয় সুনিশ্চিত। এইজন্য তাকে অলসতা ত্যাগ করতে হবে।নিদ্রা জয় করতে হবে।
সবশেষে বলতে হয় মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ নিজেই। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরে রয়েছে রাবণ। অর্থাৎ ভোগ-লালসা, দম্ভ-দর্প, অভিমান-ক্রোধ এইগুলো হল মানুষের সাধনার অন্তরায়। মানুষের শত্রু।এইগুলো হল রাবণ। কাজেই যতদিন না আমরা আমাদের এই শত্রু রাবণকে বধ করতে না পারছি ততদিন আমাদের মুক্তি নাই। তাই দেবীর কাছে আমরা প্রার্থনা করি তুমি জাগো অর্থাৎ তুমি আমাদের জড়ত্বের মোহ ঘুচিয়ে চৈতন্যের শক্তিকে জাগাও। তবেই আমাদের মুক্তি হবে।তাই মায়ের কাছে প্রার্থনা করবো তুমি আমাদের আর্শীবাদ করো যাতে আমাদের মুক্তি হয়।সবশেষে প্রবল পরাক্রমশালী অসুরকে মা দুর্গা বধ করে প্রমাণ করছেন শত্রু যতই শক্তিশালী হোক শুভ শক্তির কাছে তাকে হারতে হবে অর্থাৎ শুভর জয় ও অশুভের পরাজয় ঘটবে।এই কথাটি কি আমরা সবসময় মনে রাখি? মা দুর্গার আর্শীবাদে সকলের চৈতন্য জেগে উঠুক এই প্রার্থনাই করি।জয় মা দুর্গা।
_______________________________________________________________________________________
অভিজিৎ দত্ত
মহাজনপট্টি, পোস্ট-জিয়াগঞ্জ,
জেলা- মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ।
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন