আলোয় ফেরাঅর্পিতা মল্লিক
ফুলের মতো সুন্দর ফুটফুটে দুই মেয়ে রুম্পি আর পম্পিকে নিয়ে সুখের সংসার কণিকা ও সুজনের। শহরতলীর এক আবাসনের আট তলায় নিজেদের সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে রোজকার কর্মব্যস্ততার মধ্যেও পারস্পরিক নির্ভরতা , টান-- সুগন্ধি ফুলের গন্ধর মতো লেগে থাকতো সবসময় ।রুম্পি ক্লাস এইটে পড়ে ,ওর আঁকার হাত দারুন , একটু ছটফটে তবে অঙ্কভীতি কিছুতেই যায় না।পম্পি উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় খুবই ভালো, গানের গলাও ভালো -- এখন পড়াশোনার চাপে বিরতি নিয়েছে কিছুদিনের জন্য।ওর ডাক্তার হবার ইচ্ছে তাই 'নিট' পরীক্ষা দিয়েছে।
কণিকা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা , ওর স্কুলটা ওদের বাড়ি থেকে দুরে হবার কারণে সংসার, মেয়েদের বেশি সময় দিতে পারে না সেকারণে মনোকষ্টে ভোগে। ওদের বাবা সুজন হাসিখুশি দায়িত্ববান , এককথায় 'পারফেক্ট ফ্যামিলি ম্যান'। নিজের অফিস সামলে মেয়েদের সময় দেন। এভাবেই বাবা মা নিজেদের দায়িত্ব ভাগ করে ঘর সংসারে ভারসাম্য রেখে চলছিল।
পম্পির পরে রুম্পি হলে আত্মীয় স্বজন বলেছিল ,"আবার মেয়ে হলো , এবার দুবোনের খুব চুলোচুলি হবে"-- কিন্তু তা নস্যাৎ করে দুবোনের এতো মধুর সম্পর্ক যা সচরাচর দেখা যায় না। বিশেষত রুম্পি দিদিকে চোখে হারায়।বলে ,"আমার দিদি বেষ্ট"।বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে পরম মমতায় দুজন দুজনকে আগলে রাখে। কখনো খুনসুটি , কখনো ঝগড়া আবার পরক্ষনেই গলাগলি ভাব - ঠিক শরতের আকাশের মতো এই রোদ তো এই বৃষ্টি ।
আপাতভাবে সবকিছু ঠিক থাকলেও অশনীসংকেতের কালো মেঘ ঘনাচ্ছিল পম্পির মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে থেকে । কণিকা একটু কড়া ধাঁচের বিজ্ঞানের শিক্ষিকা, দরকার পড়লে ক্লাসের ছাত্রীদের যেমন বকাঝকা, শাস্তি দেন তেমনি পম্পির ব্যাপারেও দৃঢ়তা দেখান।
পম্পি মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করলেও ওর মনে হয় মা যেন সন্তুষ্ট নয় ওর রেজাল্টে। মাধ্যমিকে স্টার মার্কস নিয়ে পাস করে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় । মায়ের অনুশাসনে বন্ধ হয় গানের ক্লাস যেহেতু অনেকটা সময় নষ্ট হয়। মার এক কথা 'নিট' পরীক্ষায় ভালো ফল করতেই হবে প্রথমদিকে রাঙ্ক না থাকলে খুব মুশকিল -- সরকারি হাসপাতালে পড়াশোনার সুযোগ পাবে না ।
সুজন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেও কণিকা এব্যাপারে কিছু শুনতে চায় না। বলে ,"আমার স্কুল থেকে দুএকজন তো পেয়েছে গত বছর ও কেন পারবে না"।
দুবোন একসাথে ল্যাপটপে 'গেনসিন ইমপ্যাক্ট '-গেম খেলতো কিন্তু মার বকাঝকায় সব বন্ধ ।খালি স্কুল , টিউশন ,আর পড়া উচ্চ মাধ্যমিকের আগে এটাই ছিল রুটিন।রুম্পি মাঝেমাঝে ঝোড়ো হাওয়ার মতো এসে পম্পিকে ক্ষনিকের আনন্দ স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।
মায়ের প্রত্যাশা, মানসিক চাপ সবমিলিয়ে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও পম্পি বড়ই উদ্বেগে ছিল। যথাসময়ে রেসাল্ট বেরোল পম্পির রাঙ্ক প্রত্যাশার অনেক নীচে। রেসাল্ট দেখে পম্পির মুখ থমথমে হয়ে গেল ,কারো সাথে কথা বলছে না, খাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে বলে,"মা কতো আশায় ছিল কিছু করতে পারলাম না আমি"।
রুম্পি দিদিকে আদর করে বোঝায়,"এবার হয় নি তো কি হয়েছে?
আবার দেবে । তুমি কতো ভালো তুমি তো জানো দিদি । নিজের উপরে ভরসা রাখো।"
কিন্তু পম্পি একদম চুপ হয়ে গেছে।মা বকাঝকা না করলেও মায়ের হতাশাগ্ৰস্ত মুখই সব বলে দিচ্ছে।
এভাবেই দিন তিনেক কেটে গেল ।বোর্ডের পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও 'নিট' এর ফলাফলের কাছে তা ফিকে পড়ে যায়।এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেছে বাড়িতে। চতুর্থ দিন রাতে খুট করে দরজা খোলার শব্দে রুম্পির ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুবোন একসাথে এক বিছানায় শোয় ।রুম্পি দেখে বিছানায় দিদি নেই। বেডসাইড টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে রাত একটা বাজে।এতো রাতে দিদি কোথায় গেল-- মনে হতেই রুম্পির বুক কেঁপে উঠলো।এক ঝটকায় বেডরুম থেকে বেরিয়ে ওদের টেরাসে পৌঁছে দেখে দিদি রেলিংএর কিনারে দাঁড়িয়ে, এক পা প্রায় বাইরে । কেঁদে কেঁদে চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে , মুখ ফ্যাকাশে।
রুম্পি চিৎকার করে উঠল --
"দিদি ! থামো ! প্লিজ "!
জলভরা চোখে বোনের দিকে তাকায় পম্পি,
"তুই এখানে কেন"?
"আগে তুমি বলো আমি কেন আসব না? তুমি না থাকলে আমি থাকবো কেন "?
পম্পি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ,"আমি একটা ব্যর্থ মেয়ে রে.. পারলাম না , সবার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলাম, বাবা মা মুখ দেখাতে পারবে না , আমি নিজেকে সহ্য করতে পারছি না।"
রুম্পি পম্পির হাত ধরে একপাশে টেনে নিয়ে আসে,
"তুমি ব্যর্থ নও, মানুষ মাত্রই ভুল করে , পরীক্ষার নম্বর দিয়ে তোমাকে মাপা যায় না। তুমি আমার দিদি - আমার আদর্শ। তুমি না থাকলে আমি কার উপর ভরসা করবো"?
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে পম্পি,"আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম রে-- কি যে হলো"।
"আমি জানি দিদি , এবার না হয়েছে তো কি সামনের বছর দেবে , নিশ্চয়ই ভালো ফল হবে কিন্তু তুমি যদি হাল ছেড়ে দাও আমরা তো হেরে যাব"।
রুম্পি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দিদিকে ।
কান্নাভেজা গলায় পম্পি বলে, "ডাক্তার হয়ে আমি বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম , কিন্তু এখন তো আমি শুধু লজ্জার কারণ"!
"এভাবে কাঁদিস না দিদিভাই , তোকে এভাবে দেখতে আমার একদমই ভালো লাগে না। আমরা সবাই আছি তোর পাশে।"
দুবোন টেরাসের এক কোণে বসে পড়লো ।আটতলার উপর থেকে নীচের সবকিছু বড় ছোট লাগে। বাইরের মেন গেট বন্ধ করে সিকিউরিটিরা ঘোরাঘুরি করছে। ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঝলমল করছে নীচের লন ।এর মধ্যে দিদি কি ঘটাতে চলেছিল ভাবতেই রুম্পির হাতপা ঠান্ডা হয়ে যায়। দুজনের গাল বেয়ে নোনা জল নেমে যাচ্ছে -- যেন অনেক দিনের জমে থাকা ভার নেমে গেল।
ইতিমধ্যে টেরাসের স্লাইডিং খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওদের বাবা মায়ের , ধীর পায়ে ওনারা দুজনের কাছে এলো। কণিকা আত্মগ্লানিতে ভেঙ্গে পড়ে পম্পিকে বুকে জড়িয়ে বলে ,"আমি এতো খারাপ মা যে তোর ভেতরে কি চলছে কিছুই আঁচ করতে পারিনি,কি করতে যাচ্ছিলি ? একবার আমাদের কথা মনে হলো না, তোকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমরা?
কান্নায় গলা বুজে আসে কণিকার ,রুম্পির দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকলে সে মায়ের বুকে মুখ গুজে দেয়। সুজন বলে, "এটাই পরিবারের বন্ধন , আমরা কেউই কাউকে ছাড়া সম্পুর্ন নয়। জীবন কি এতো সস্তা নাকি? জীবনের পথে কতো পরীক্ষা আসবে , তাতে কখনো আমরা সফল হই কখনো বিফল ।ব্যর্থ হয়ে ভেঙ্গে পড়লে কি করে চলবে?"
কণিকা বলে,"কাল এক নতুন সকাল হবে, সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে "
মায়ের কথায় পম্পির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।সে বোনকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে ,""তোর জন্যই আজ আমি বেঁচে আছি , তুই আমার রক্ষাকারী "।
পম্পি বুঝতে পারে ব্যর্থতা মানে সফলতার দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়া। ব্যর্থতার ইটে পা দিয়ে তবেই তো সাফল্যের ইমারতের দিকে এগোনো যায়। নতুন করে সব শুরু করার প্রতিজ্ঞা করে নিজের কাছে।
এর কিছুদিন পর পম্পি আবার কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। জোর কদমে 'নিট' পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। কণিকাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে পম্পির পাশে থাকে। আর রুম্পি তো বন্ধু,সঙ্গী ও সাহসের বাতিঘর।
এভাবে কাছের মানুষের সাহচর্যে পম্পি আলোয় ফিরে এলো।
_____________________________________________________________________________________
অর্পিতা মল্লিক
৪৬৮ ড্রিম পার্ক, ব্লক-বি১,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন