তিতলির বিশ্বভ্রমণ (তৃতীয় পর্ব) অরুণ চট্টোপাধ্যায়
বিশ্বপরিক্রমা
এক
গিরিরাজের ডাক
-আফ্রিকা যেতে গেলে তো গিরিরাজকে ডিঙ্গোতেই হবে গো তিতিলিদিদি।
হাতিদাদার কথায় চমকে উঠল সবাই। তিতলি তো বটেই পুচকিও। সে কম কথা বলে তবে কৌতূহল বেশি। জিজ্ঞেস করল, গিরিরাজ কোন দেশের রাজা গো হাতিদাদা?
চনমন করে অমনি হেসে উঠল তিতলি, তুই একটা আস্ত বোকারাম পুচু। গিরি মানে জানিস না?
বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে চুপ করে রইল পুচকি খানিক। তারপর বলল, জানব না কেন? জানি তো। গিরি মানে হল পাহাড়।
তিতলি সবজান্তার হাসি হেসে বলল, পাহাড় নয় পাহাড় নয় পর্বত রে পর্বত।
ফ্যালফ্যাল করে দিদির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুচকি বলল, দুটো আলাদা বুঝি?
দাদু এতক্ষণ মুচকি হাসছিল। এবার বলল, বোনকে পার্থক্যটা বুঝিয়ে দাও তো দিদি?
আর দিদি ততক্ষণে যেন দিদিমনি হয়ে উঠেছে দিব্বি। ভারিক্কি চালে তিতলি বলল, শোন তবে পুচু। পাহাড় হল ছোটখাট। আকারেও যেমন ছোট উচ্চতাতেও তেমন খাটো। আর লম্বাতেও।
-লম্বা? পাহাড় আবার লম্বা হয় নাকি দিদি? সে কি মানুষ?
-মানুষ নয় বলে কি আর কেউ লম্বা হয় না? গাছপালার কথাই ধর না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পুচকি বলল, তা পর্বত কি লম্বা হয়?
এবার দাদু এগিয়ে এল। জিনিসটা ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। হেসে পুচকির দিকে চেয়ে বলল, অযোধ্যা পাহাড়ে গেছ কখনও পুচকি?
তিতলি লাফিয়ে উঠল আনন্দে, হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো গত বছরে গেছি জেঠুর সঙ্গে। খুব ভাল লেগেছে। পুরুলিয়াতে। কি সুন্দর-মার্বেল লেক, আপার ড্যাম লোয়ার ড্যাম কত কিছু।
সে এত জোরে নেচে উঠেছিল যে আর একটু হলেই হাতিদাদার পিঠ থেকে পড়ে যেত। হাতিদাদা অমনি ঘাড় নেড়ে তার গলার ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দিল, সামহালকে!
পুচকিও সাবধান করল, দিদি আস্তে রে। পড়ে যাবি। মাটি কত নিচে তা জানিস? দেখতে পাচ্ছিস নিচে কিছু?
সত্যিই নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু নিচে কেন ওপরে, পাশে পেছনে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। পাকানো পেঁজা তুলোর মত মেঘের মধ্যে দিয়ে চলছে তারা।
দাদু আবার বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। আচ্ছা শুশুনিয়া পাহাড়ে গেছ?
পুচকি বলল, হ্যাঁ গো দাদু গেছি গতবছরের আগের বছরে।
তিতলি বলল, সে তো বাঁকুড়া জেলায় তাই না দাদু?
-হ্যাঁ ঠিক বলেছ। আচ্ছা এবার বল তো দার্জিলিং গেছ?
তিতলি আবার লাফিয়ে উঠল তবে এবার একটু সাবধানে।
-বাপরে কি উঁচু আর কত বিশাল।
মনমরা হয়ে পুচকি বলল, সেবার ক্লাস টেস্ট বলে বাবা নিয়ে গেল না। তবে কিছুদিন পরে শিলং গেছিলাম।
দাদু বললেন, এই দার্জিলিং হল হিমালয় পর্বতে। যেমন বিশাল তেমনি উঁচু। ভারতের উত্তর দিক পুরো ঘিরে রেখেছে। একেবারে পূর্ব থেকে পশ্চিম গোটাটাই।
হাতিদাদা তো উড়েই চলল তার বড় বড় ডানা মেলে। উড়তে গেলে আকাশের এদিক সেদিক তো খেয়াল রাখা চাই। সর্বদা কথা বলে গেলে হয় না। অন্যমনা হয়ে পড়লে খুব মুশকিলে পড়তে হয়। আকাশের অত ওপরেও পাখির অভাব নেই। বাজপাখী, শকুন, চিল কি না আছে? এরা আকারে হয়ত হাতিদাদার মত বিশাল নয় কিন্তু এদের ঠোঁটে ভারি জোর। কে কোথা দিয়ে মাথায় এসে ঠোক্কর মেরে বা ডানার ঝাপটার চাঁটি মেরে দিলে তো মহা ঝামেলা। এমন এক চাঁটিতে অজ্ঞান হয়েও যেতে পারে। আর মাথা ঘুরে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে গেলে কি হবে?
তবে গল্পদাদুকে নাকি অনেক পশুপাখী দিব্বি চেনে। পশুপাখীকে নিয়ে তিতলিদিদিকে বলা এমন সব চমৎকার গল্প অল্পবিস্তর সব পশুপাখীর কানেই গেছে। তাই তারা তিতলিদিদির গল্পদাদুকে খুব পছন্দ করে। আর সেই দাদুর কৃপায় চিনে গেছে তিতলির বাঘুমামা, সিঙ্ঘিমামা, রাইনোদাদা, হাতিদাদা, মিউমাসি, কাজলনয়না দিদি, ঘৌদাদা, টিয়ারাণী বা কাঠুভাইকেও। এদের ক্ষতি কেউ কখনও করবে না। আর না জেনে অন্য কেউ যদি করে তো এরা বুক পেতে আগলাবে এই যা ভরসা।
তবু সাবধানের তো মার নেই। এতগুলো প্রাণ তার হাতে। তাই হাতিদাদা চুপ করে রইল। চুপ করে রইল আর সবাই। কিন্তু পুচকি হঠাৎ বলে উঠল, বা রে আমার প্রশ্নটাই তো ধামাচাপা পড়ে রইল।
তিতলি বলল, কি প্রশ্ন রে পুচু?
-বাহ আমি যে জিজ্ঞেস করলুম গিরিরাজ কোন দেশের রাজা?
দাদু মুচকি হেসে চুপ করে রইল। তিতলি বলল, আমার মনে হয় গিরিদের রাজা রে পুচু।
এবার কথা কয়ে উঠলেন দাদু, হ্যাঁ তিতলিদিদি ঠিক বলেছে। পাহাড় হল আকারে, উচ্চতায় বা লম্বায় ছোট। কিন্তু পর্বত হল সব দিক থেকে বিশাল। যেমন অযোধ্যা বা শুশুনিয়া হল পাহাড় কিন্তু উড়িষ্যার নীলগিরি বা ভারতের দক্ষিণ পূর্ব বা দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা পূর্বঘাট বা পশ্চিম ঘাট হল পর্বত। আবার অনেক পর্বত শৃঙ্গ মিলে বিশাল হল পর্বতমালা। যেমন রাজস্থানের আরাবল্লী, হিমালয় এইসব।
দুই বোন তন্ময় হয়ে শুনছিল। পুচকি হঠাৎ দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি সুন্দর করে বললে তুমি দাদু। আমার খুব ভাল লাগল।
তিতলি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আমারও।
হাতিদাদা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমারও।
তার গলার ঘন্টা জোরে জোরে বেজে উঠল। সেই ঘন্টায় নড়ে চড়ে বসল যেন এটিসি মানে এয়ার ট্র্যাফিক কনট্রোল। আকাশের পাহারাদার বা ট্র্যাফিক পুলিশ। রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে বলল, সাবধান দাদু। আর এগোবেন না কিন্তু।
আকাশে আবার বাধা
এই এ-টি-সিও চেনে দাদুকে। বলল, আমিও আপনাকে চিনি দাদু।
দাদু বলল, নো নো আই অ্যাম-
-ছাড়ুন দাদু ছাড়ুন। আমি আপনার মতই বাঙ্গালী। আমার নাম সুধাকর গাঙ্গুলি। আমাকে আপনি আপনি করতে হবে না। তিতলিদিদি আর পুচকির মত আমিও আপনাকে দাদু বলব-
তিতলিরাও শুনতে পাচ্ছিল কথাগুলো। কারণ সব ভাষা বাংলায় হয়ে যাবার দাদুর আবিষ্কৃত যন্ত্র তাদের প্রত্যেকের কানে। এমন কি হাতিদাদার কানেও। তিতলি অবাক হয়ে বলল, উনি আমাদের নাম জানেন?
তাকে অবাক করে দিয়ে এ-টি-সি সুধাকর গাঙ্গুলি মিষ্টি স্বরে বললেন, চিনি গো চিনি আমার তিতলি বোন। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের এ-টি-সি মিঃ কোহলি আমাকে সব বলেছেন। উনি তোমাদের কেরল আর গির নিরাপদে পার করে আমাকে বলে দিয়েছেন আমি যেন তোমাদের নিরাপদে গিরিরাজ পার করে দিই। তোমাদের মত দুই বাচ্চা আর তোমাদের পশুপাখী বন্ধুরা এখন সকলের খুব প্রিয় হয়ে গেছ। আর অবশ্যই সেটা দাদুর কল্যাণে।
খুব আনন্দে তিতলি আর পুচকি হাততালি দিয়ে জোরে জোরে দুলে উঠল। হাতিদাদা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। দাদুর প্রশংসা এরা সবাই শুনতে খুব ভালবাসে বোঝা গেল।
হিমালয় থেকে নাকি খুব ঠান্ডা ঝড় ধেয়ে আসছে। বরফের ঝড়। ঠিক হিমাচলের মাথার ওপর রয়েছে তারা। এখনই মাটিতে নেমে না পড়লে বরফের কুচি ছিটকে ছিটকে এসে তাদের গায়ে পড়তে পারে। আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে।
দাদু তাদের আশ্বস্ত করলেন। হাতিদাদার পায়ের নিচে তিনি এমন এক নরম প্যাড তৈরি করে দিয়েছেন যা টিকটিকির মতই মাটিতে পড়ে স্প্রিং করবে। ধাক্কা লাগার ভয় নেই। তবে এখানেই ধীরে ধীরে নামতে হবে।
এমন সময় এক অদ্ভুত কান্ড হল। অদ্ভুত কান্ডটা আর কিছুর জন্যে নয়। এতক্ষণ চলছিল বরফের ঝড়। এবার নামল বরফের বৃষ্টি। জলের বৃষ্টিতে জল পড়ে আকাশ থেকে। কিন্তু এখানে এই এত উঁচুতে হিমালয় পাহাড়ের মাথার ওপর আর ঠান্ডা এত বেশি যে জল আর কোথায় পাওয়া যাবে? সব জল সে বরফ হয়ে গেছে। তাই বৃষ্টি হলেও সেটা হবে বরফের বৃষ্টি।
সবাইকে সেটাই বোঝাচ্ছিল দাদু। তিতলি বোনকে জিজ্ঞেস করল, বুঝেছিস পুচু?
পুচু বলল, কী এমন শক্ত ব্যাপার শুনি যে তোর পুচু বুঝবে না?
দাদু কিছু বলার আগেই বৃষ্টি বেড়ে গেল। গায়ে রীতিমত বিঁধতে লাগল বরফের টুকরোগুলো। তিতলি অধীর হয়ে বলল, দাদু কিছু একটা কী করা যায় না? দেখ না হাতিদাদার কত কষ্ট হচ্ছে এই ঠান্ডায় আমাদের বইতে। তাতে আবার এই বরফের টুকরোগুলো ছুঁচের মত বিঁধছে ওর মাথায় আর চোখে।
দাদু খুব বিচলিত আর ব্যস্ত ছিল। তা তো কী আর করবে। হাতিদাদা বলল, আমার জন্যে তুমি ভেবো না দিদি। আমার এতবড় শরীরে কিছু হবে না, তবে খুব ভাল লাগছে এই বিপদের সময় তোমরা তোমাদের কথা না ভেবে আমার কথা ভাবছ।
পুচকি এমনিতে কথা খুব কম বলে। তবে এখন সে আর পারল না। বলল, এ আবার কেমন কথা গো হাতিদাদা? তুমি আমাদের নিয়ে কষ্ট করে উড়ছ তাই তো আমাদের বিশ্বভ্রমণটা হচ্ছে।
এমন সময় মাথা জোরে জোরে নাড়ার জন্যে হাতিদাদার গলার ঘন্টা টুং টুং করে নড়তে লাগল। তিতলি বুঝল এর মানে। পুচকির কথায় হাতিদাদার নিশ্চয় কিছু অভিমান হয়েছে। হাতিদাদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দাদা গো অভিমান কর না। পুচকি কত ছোট বল?
তাকে অবাক করে দিয়ে হাতিদাদা কিন্তু পুচকির পক্ষই নিল।
-পুচকিদিদি তো ঠিকই বলেছে। ভেবে দেখ দাদু আমার ডানা দিয়েছে। এখন এই বৃষ্টি থেকে বাঁচার উপায় একমাত্র দাদুই পারে।
সবাই চাইল দাদুর দিকে। দাদু মুখ চুন করে বলল, আমি তো খাতায় এঁকে একটা ছাউনি বানিয়ে দিতে পারি এক্ষুনি। কিন্তু এই বৃষ্টিতে যে খাতা ভিজে যাবে দিদি?
তিতলি বলল, হ্যাঁ তাও তো ঠিক।
এমন সময় পুচকি ভয়ে চিৎকার করে উঠল, দিদি রে দেখ।
বিপদ বলে বিপদ। একটা বিরাট পাখি আকাশে দিয়ে উড়তে উড়তে ঠিক তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়তে লাগল। পুচকি চেঁচিয়ে উঠল, বাবা গো। ঠোক্কর মারলেই তো গেছি।
আকাশের পাহারাদার
সবাই তো ভয়ে একেবারে অস্থির। দাদু কেবল ভয় পায় নি। বলল, ভয় নেই তোমাদের। এ আমাদের সাহায্য করতেই এসেছে।
সবাই তো অবাক। মাথার ওপর এত বড় একটা পাখি তার বিরাট ছায়া বিস্তার করেছে।
-তুমি ঠিক বলেছ দাদু। তোমায় ধন্যবাদ। তুমি তোমার নাতনিদের কাছে আমার সঠিক মনোভাব ব্যক্ত করেছ।
কে বলল কথাটা? খুব যে মোটা গলায় তা তো নয়? কেমন যেন চেরা চেরা চিঁ চিঁ গলায়। পুচকি খুব ভয় পেয়ে গেল। তিতলি পর্যন্ত বুঝতে না পেরে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে দাদুর মুখের ভাব বলে দিচ্ছে ভয় মোটেই নেই। কারণ দাদুর মুখে বেশ একটা দুষ্টু-মিষ্টি হাসি।
-তবে আমি নিজেই আমার পরিচয়টা দিই। সকলের মাথার ওপর থেকে গ্রীফিন পাখিটা বলল, আমার নাম গ্রীফিন। আমি হিমালয়ের অনেক উঁচুতে এই বরফ ঢাকা অঞ্চলে উড়ে বেড়াই এক মহাচিল। আমার বিরাট লম্বা ডানায় ঢাকা পড়ে যায় এক বিরাট অঞ্চল। তিতলি, পুচকি। দাদু আর হাতিদাদারা সব শোন। এই যে বরফ-ঝরা বৃষ্টি এটা বড় খারাপ। এই বৃষ্টি তোমাদের গায়ে পড়লে তোমাদের এমন ঠান্ডা লাগবে যে সর্দি কাশি জ্বর। তোমরা সামলাতে পারবে না।
পুচকির নাম নিয়েছে মাথার ওপরের এই বিশাল পাখিটা। তার খুব আনন্দ হচ্ছে। তিতলির কানে কানে বলল, আমাদের সকলের নাম জানতে পারল কেমন ভাবে রে দিদি?
উত্তর তিতলি দিল না। উত্তর এল গ্রীফিনের কাছ থেকে, আমি আকাশের অনেক উঁচু থেকে সব কিছু যেমন দেখতে পাই তেমনি শুনতেও পাই লোকের ফিশ ফিশ কথাটাও।
-হ্যাঁ যা বলছিলুম। এই হিমালয়ের ওপরের অঞ্চলটা আমার। আমিই পাহারাদারি করি। তার মানে আমাকে খারাপ বুঝো না তোমরা। পাহারাদারি করি মানে কেউ যদি বিপদে পড়ে তো তাকে সাহায্য করি।
দাদু এবার মুখ খুলল, এই যেমন গ্রীফিন ভাই তার বিশাল ডানা দিয়ে এখন আমাদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করছে।
-তুমি খুব ভাল বলেছ দাদু, গ্রীফিন খুশি হয়ে বলল, তবে তোমাদের পেট খারাপ কি মাথা ব্যথা করবে আমাকে বলবে। এই হিমালয়ে এমন কিছু নেই যা আমাদের খারাপ করে। বরং সব কিছুই কাজে লাগে। এই যেমন-
দাদু খুব মিষ্টি করে বলল, কী গ্রীফিন ভাই?
-কত দরকারি গাছ আছে এখানে জান? গাছেরাই তো আমাদের প্রাণ বাঁচায় দাদু। কারোর পাতা তো কারোর শেকড়। কারোর ফুল তো কারোর ফল। কারোর কান্ড তো আবার কারোর ছাল।
পুচকি চোখ বড় বড় করে বলল, তাই নাকি গো গ্রীফিন দাদা?
গ্রীফিন বলল, হ্যাঁ গো পুচকি দিদি।
-আমার মাথা ব্যথা করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
গ্রীফিন খুব নরম গলায় বলল, দিদি তবে আর একটু সও। এখন এই বৃষ্টিতে তোমাদের ফেলে যেতে পারবা না, বৃষ্টিটা একটু ধরুক। আমি ঠিক খুঁজে খুঁজে পাতা এনে দেব।
তিতলি বলল, হ্যাঁরে পুচু তোর খুব মাথা ব্যথা করছে? আয় তোর মাথা টিপে দিই।
উড়তে উড়তে গ্রীফিন বলল, আচ্ছা দাদু তোমরা কোথায় চলেছ?
-বিশ্বভ্রমণে বিশ্বভ্রমণে। তিতলি আর পুচকি সমস্বরে বলে উঠল।
দাদু বলল, নিজের দেশ ভারতটা মোটামুটি শেষ করেছি গ্রীফিন ভাই।
হাতিদাদা বলল, এবার বিশ্বজয়ের পালা গো গ্রীফিন দাদা।
গ্রীফিন বলল, বেশ তো আমি তোমাদের হিমালয়ের এই বরফ অঞ্চল্টা পার করে দেব।
দাদু বলল, তাহলে তো খুব ভাল হয় গ্রীফিন।
-কিন্তু তারপর আপনারা কোথায় যাবেন দাদু? পূবে নাকি সোজা রাশিয়ার ভেতর দিয়ে ইউরোপ? সেটা সেরে আমেরিকা?
দাদু কিছু বলার আগেই দুই বোন চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে, আফ্রিকা আফ্রিকা।
-কেন আফ্রিকা কেন? সে তো বড় ভয়ের দেশ-
আকাশের নতুন বন্ধু
দাদু শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ এক কালে বলত বটে ডার্ক কন্টিনেন্ট বা অন্ধকার মহাদেশ। তবে আজ এই ডিজিট্যাল যুগে তো সব পালটে গেছে গ্রীফিন ভাই। অন্ধকার তো আস্তে আস্তে কমে আসছে।
গ্রীফিন একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তা ঠিক। তবে কী জানেন দাদু। ওখানে খুব বড় বড় জন্তু আছে। খুব ভয়ঙ্কর।
-বাঘুমামা, সিংহমামা, ভালুভাই, রাইনোদাদা আরও কত কী। আমাদের সব আলাপ হয়ে গেছে। আর হাতিদাদাকে তো দেখচ্ছই কত ভালবেসে আমাদের আকাশ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
তিতলি আর পুচকি একসঙ্গে বলল।
গ্রীফিন তা সত্ত্বেও বেশ চিন্তিত ভাবে বলল, আলাপ তোমাদের সকলের সঙ্গে হয়েছে বটে তবে আফ্রিকায় কিন্তু সব খুব বড় বড় আকারে। আর ওখানে আছে বনমানুষ, শিম্পাঞ্জি, বিরাট কানওলা বুশ হাতি। তারপর গরিলা।
পুচকি বলল, আমরা সব বন্ধু করে নেব। কী বলিস রে দিদি?
তিতলি বলে উঠল, হু অমনি সব সোজা নাকি? আমাদের হাতি দাদা ছিল। তাই তো আমাদের সোদরবনের বাঘুমামার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারপর এক এক করে সব। নন্দনের বাঘ মামি, কেরলের সব হাতিদাদারা, গির অরণ্যের সব সিংহ মামারা।
গ্রীফিন বলল, ভয় নেই আমি তোমাদের আইবিসদাকে বলে দেব।
পুচকি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, আইবিসদা কে গো?
তিতলি বলল, আহঃ পুচু তোর শুধু সবটাতেই ভয়। ও তো একটা পাখ নাকি? আকাশে ওড়ে।
-হ্যাঁ আকাশে ওড়ে। খুব উঁচু আকাশে, গ্রীফিন বলল, আর কী বিরাট পাখি তোমরা ভাবতে পারবে না তার ডানা কী বিশাল লম্বা ঠোঁট। আর তেমনই লম্বা গলা। ঠোঁট আত গলা মিলিয়ে শরীরের প্রায় অর্ধেকটা হয়ে যাবে।
তিতলি বলল, সে কী করবে?
গ্রীফিন বলল, সে হল এক আফ্রিকান পাখি। এটা জানো তো পাখিদের উড়তে কোনও পাসপোর্ট লাগে না? সে এশিয়া থেকে আরিকা পর্যন্ত কাশে ওড়ে। অনেক কিছু দেখে। আবার ফিরে আসে মাটিতে। মাটিতেও ওর অনেক বন্ধু আছে। আকাশ থেকে যেমন সে জঙ্গল দেখে তেমনি দেখে নদ-নদী-পাহাড় আবার সাগর-
পুচকি বাধা দিয়ে বলল, ঠিক তোমার মত গিফিন দাদা?
পুচকি এখনও র-ফলা ভাল করে উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু গ্রীফিন এতে রাগ না করে খুব ম্লান সুরে বলল, আমার তো সে উপায় নেই গো দিদি। আমাকে এই উঁচু হিমালয়েই পাহারা দিতে হয়। কত ইচ্ছে নদ-নদী সাগর আর তোমাদের ঘরবাড়ি দেখি। কিন্তু সেখানে যাওয়া খুবই মুশকিল গো তিতলি দিদি।
তিতলি জিজ্ঞেস করল, কেন গো গ্রীফিন দাদা? তোমার তো এত বড় বড় দুটো ডানা আছে। পাহাড় থেকে সাগরে তো খুব সহজেই যেতে পার?
বড় দুঃখের সঙ্গে গ্রীফিন বলল, আমি যে ঠান্ডার দেশের পাখি গো। তোমাদের সমতলের বা সাগরের গরম সহ্য হবে কেন?
গ্রীফিনের খাতিরদারি
ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। গ্রিফিন বলল, তোমাদের নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে আমার এই বন্দিদশায়?
পুচকি বলল, মুক্ত অথচ বন্দি। খুব দুঃখ গো তোমার।
তিতলি বলল, সত্যি। নানা জায়গা না দেখতে পেলে আমাদের খুব ভাল লাগে। ভাগ্যি দাদু ছিল।
পুচকি বলল, হ্যাঁ ঠিকই তো। দাদুই তো গল্প বলে বলে আমাদের সঙ্গে পশুপাখিদের বন্ধুত্ব তৈরি করে দিল। তারপর হাতিদাদার পিঠে ডানা এঁকে দিল। সেই ডানাতে ভর করে হাতিদাদা আমাদের সোদরবনে নিয়ে গেল। আলাপ হল কত জনের সঙ্গে।
-আর নাম করতে হবে হাতিদাদার, পুচকি বলল, সেই কবে থেকে আমাদের আকাশে বয়ে বেড়াচ্ছে। আহা বেচারির কত কষ্ট।
হাতিদাদা চিঁহি করে ডেকে উঠল। মনে হয় পুচকির কথায় আপত্তি করছে সে।
তিতলি জিজ্ঞেস করল, কী হল গো হাতিদাদা? তুমি অমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন? আমাদের কথা কি তোমার খারাপ লাগল?
হাতিদাদা এবার জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল। আর জোরে জোরে দুলে উঠল তার গলার ঘন্টাগুলো। আর সেই ঘন্টার শব্দ।
সেগুলো থেমে গেলে সে বলল, তা খারাপ লাগবে না কেন শুনি? তোমরা হলে আমার দিদি সব। আর উনি আমার দাদু। কত ভালবাসার লোকজন। আর আমাকে কিনা বলছ তোমাদের বইছি বলে কষ্ট হচ্ছে? কত আনন্দে আমি তোমাদের বইছি তা যদি জানতে।
হাতিদাদা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাদু বলল, তোমাদের বইতে নয় বরং তোমাদের কথায় হাতিদাদার কষ্ট হয়েছে।
তিতলি বলল, সরি হাতিদাদা। আমরা তোমাদের দুঃখ দিতে চাইনি। আমরা তো সত্যি কথাই বলেছি। তুমি প্লিজ কিছু মনে কর না।
পুচকি বলল, আমিও সরি বলছি হাতিদাদা।
হাতিদাদা বলল, আরে না না। তোমরা যে আমার আদরের বোন। আমি কি তোমাদের ওপর রাগ করতে পারি? তবে সত্যি কথাগুলো একটু ভেবে বলবে। অনেক সময় সত্যি কথাটাও সবাইকে দুঃখ দেয়।
গ্রীফিন এতক্ষণ সব শুনছিল। এবার বলল, আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি তোমাদের এই বন্ধুত্ব দেখে। সারা জগত যদি তোমাদের মত বন্ধুত্ব দেখাতে পারত তো জগতে এত দুঃখ এত কষ্ট থাকত না।
তিতলি, পুচকি আর হাতিদাদা সবাই সমস্বরে বলে উঠল, সব হয়েছে আমাদের দাদুর জন্যে। দাদু যেমন গল্প বলতে পারে তেমনি সে পারে ছবি তৈরি করতে। তার জন্যেই আজ আমরা দুই বোন কত বন্ধু পেয়েছি। সারা জগত দেখার জন্যে একটা আকাশ গাড়ি পেয়েছি।
গ্রীফিন বলে উঠল, দাদু জিন্দাবাদ।
বাকি সবাই সমস্বরে তার প্রতিধ্বনি করে উঠল, দাদু জিন্দাবাদ। দাদু আমাদের ভালবাসা।
দাদু মিটি মিটি শুধু হেসে গেল। গ্রীফিন বলল, আমার তরফ থেকেও তোমাদের যতটা করা সম্ভব তা নিশ্চয় করব। অন্তত আপ্রাণ চেষ্টা তো করবই।
বিদায় গিরিরাজ
গ্রীফিন খুব খুশি এমন বন্ধুর দল পেয়ে যারা নাকি সারা ভারত ভ্রমণ শেষ করে গিরিরাজ হিমালয় পার করে আফ্রিকা যেতে চাইছে যা হল পশুপাখিদের স্বর্গরাজ্য। এরা সবাই পশুপাখিদের খুব ভালবাসে। আর পশুপাখিরাও এদের। তাই এদের জন্যে তাকেও তো কিছু করতে হবে।
বলল, হাতিদাদা যতই বলুক পুচকিদিদির কথাটাই ঠিক। হাতিদাদার বড় কষ্ট। দাঁড়াও হাতিদাদা আমি তোমার ব্যবস্থা করছি।
হাতিদাদা তো অবাক। কী এবার ব্যবস্থা করবে? তিতলিদিদি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল, কী আবার করবে গো গ্রীফিন দাদা?
-আমি নয়, গ্রীফন বলল, করবে আমাদের এই দাদু। মানে গল্পদাদু বা আঁকা দাদু যাই বল। দাদু পারবে তো?
তিতলি আর পুচকি অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল একসঙ্গে, পারবে না মানে? দাদু পারবে না বলে কী আছে শুনি?
গ্রীফিন দাদুর দিকে চেয়ে রইল। দাদুর মুখে শুধু মিটি মিটি হাসি। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। সবাই তো এখন মাটিতেই বসে আছে। সবাই মানে হাতিদাদা আর গ্রীফিন। বাকিরা তো সব হাতিদাদার পিঠে।
গ্রীফিন মুচকি হেসে তাকালো দাদুর দিকে, কী দাদু আমি কী বলতে চাইছ তা বুঝেছ তো?
দাদু খুব বেশি কথা বলে না। কথা কম কাজ বেশি এই হল দাদুর নীতি।
দাদু ঝট করে তার ব্যাগ থেকে খাতা আর সেই আশ্চর্য পেনটা বার করল। ফট ফট করে একটা ছবি আঁকল তারপর সেটা গ্রীফিনের ডানার ওপর বসিয়ে দিল। সবাই দেখেছে সে ছবি। সে ছবি হল বিরাট বড় ডানার। একটু পরেই গ্রীফিনের ডানা বিশাল হয়ে গেল। গ্রীফিন হাসিমুখে বলল, এখন হাতিদাদা তুমি যেমন আছ তেমনি ভাবে আমার পীঠে ওঠ। তোমার পিঠে বাকি সবাই থাক।
সবাইকে পিঠে নিয়ে যেন জয়ধ্বনি করে উঠল গ্রীফিন। আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল সবাই। আপাতত হিমালয়ের সীমানাটা পার করে দেবে গ্রীফিন। এই জায়গা বড় বিপদ সংকুল। ঠান্ডা প্রচুর। আছে বরফের বৃষ্টি, আছে তুষার ঝড়। আছে আরও নানা অজানা বিপদ। এই সব থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে গ্রীফিন। আকাশের সে সব জ্যয়গাই জানা আছে তার।
অতএব বিদায় গিরিরাজ বিদায়। সবাই গ্রীফিনকে ধন্যবাদ দিল। গ্রীফিন সবাইকে ভালবাসা জানাল। সে আকাশে ঠিক সময় তার বিশাল ডানা না মেলে দিলে মারাত্মক তুষারবৃষ্টি যে আরও কত মারাত্মক হয়ে উঠত সবাই তার উল্লেখ করল।
আপাতত বিশ্বভ্রমণের তৃতীয় ধাপ। আফ্রিকার পথে।
দুই
আইবিসদা
আকাশেই দেখা আইবিসদার সঙ্গে। ধরতে গেলে আইবিসদার হাতে তাদের ধরিয়ে দিয়ে গেল গ্রীফিন। ভাল করে বুঝিয়ে দিল তিতলির এই বিশ্ব ভ্রমণের ব্যাপারটা। আইবিসদা একটু গম্ভীর স্বভাবের। তবু হাসির তেমন ঘাটতি হল না। তার সারা গায়ে পড়া রোদের চকচকে ভাবটার মত খুশি চকচক করে উঠল তার সারা মুখে।
সেখান থেকে বিদায় নিল গ্রীফিন। দায়িত্ব নিল তিতলিদের সঙ্গে মহাকায়ার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার। এই 'মহা' শন্দটা পুচকিকে বেশ ভয় ধরিয়ে দিল। সে জানে কায়া মানে শরীর বা দেহ। তাহলে মহাকায়া মানে বেশ বড় সড় শরীর। তিতলির দকে ভয়ে ভয়ে চেয়েছিল পুচকি। তার ভয় দেখে মনে মনে একটু হাসি এলেও গম্ভীর হয়ে আইসবিদা বলল, আমাকে দেখে গম্ভীর মনে হলেও ভেব না আমি তোমাদের বন্ধু হতে পারব না। দাদু তোমার কী মনে হয়?
আসলে দাদু তো কত মানুষ দেখেছে এ পর্যন্ত। শুধু মানুষ নয় কত পশু, পাখি, কীট পতঙ্গ আর গাছ। হেসে বলল, ঠিক বলেছ দাদুভাই। তোমাকে গম্ভীর দেখালেও তুমি বেশ হাসিখুশি তা বুঝতে পারছি।
হাতিদাদার পিঠে যেমন তারা তিনজন ছিল তেমনি উড়তে লাগল। আর আইসবিধা উড়তে লাগল তার পাশাপাশি। উড়তে উড়তে সে বলতে লাগল, আমাদের এই সুন্দর আফ্রিকা মহাদেশ মোট চুয়ান্নটা দেশ নিয়ে গঠিত দাদু। নদী, নালা, বনজংগল, ফল ফুল আর পশুপাখি নিয়ে সুন্দর আমাদের এই সংসার। দক্ষিণ আফ্রিকায় তোমাদের মত বাংলার অনেক মানুষ আছে গো তিতলিদিদিরা। আর আছে হাতিদাদার মত হাতি, গন্ডার, বনমানুষ। তাছাড়াও আছে বাঘ, সিংহ, হায়েনা, বনমহিষ, বন খরগোস, শেয়াল সব কিছু। আছে শিম্পাঞ্জি আর মহাকায়।
পুচকি যেন হোঁচট খেল। এই নামটা যেন এর আগে কোথায় শুনেছে। সে চাইল দিদির দিকে। তিতলি বুঝল বোন কী বলতে চায়। সে বলল, এটা এর আগে গ্রীফিন দাদা বলেছে আমাদের। হ্যাঁগো আইবিসদা এই মহাকায় কী খুব ভয়ঙ্কর জন্তু?
আইবিস বলল, জন্তু? জন্তু কেন হবে? সে তো তোমাদেরই মত দেখতে। ঠিক তোমাদেরই মত দুটো পায়ে চলাফেরা করে। দুটো হাত রয়েছে তার কাজ করার জন্যে। তবে তার চেহারা তোমাদের চেয়ে অনেক বড়। খুব লম্বা সে। আর বেশ বুদ্ধিমান।
দাদু বুঝিয়ে দিল, কায়া মানে কী?
পুচকি চট করে বলল, জেঠু বলেছে। কায়া মানে শরীর।
-আর মহা মানে?
তিতলি বলল, মহা মানে খুব বেশি বা খুব বড়। জেঠু বলেছে।
আইবিসদা বলল, জেঠুও আছে বুঝি তোমাদের?
-হ্যাঁ জেঠু আমাদের খুব ভালবাসে আর আমাদের সব কিছু বলে। আমরা যা জেনেছি তার প্রায় সব জেনেছি জেঠুর কাছ থেকে।
-সব নয়। পুচকি যেন ফুঁসে উঠল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। দাদুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দাদুই তো সব জানায় আমাদের। যা ভুল হয় সব ঠিক করে দেয়। আর ঠিক বলার জন্যে খুব ভালবাসা দেয়।
-শুধু ভালবাসা নয়। পুচকি বলল, চকোলেট পর্যন্ত দেয়।
আইবিসদা বলল, চকোলেট খাও দাঁতে পোকা হয় না? আমরা অবশ্য খাই না। তবে নিচে পড়ে থাকলে কখনও কখনও টুক করে তুলেও নিই।
তিতলি হেসে বলল, না গো দাদা। দাদু বলে ভাল কোম্পানীর চকোলেট ভাল জিনিস দিয়ে তৈরি ওসব খেলে খারাপ হয় না।
বুশদার আপ্যায়ন
তারা বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকে গেছে আফ্রিকার। এখন গহন অরণ্য চলছে। হাতিদাদা নিচে কী একটা দেখে একটু দাঁড়িয়ে গেল। তিতলি জিজ্ঞেস করল, নিচে কী দেখছ হাতিদাদা?
হাতিদাদা খুশির আনন্দে ঘন্টা নেড়ে নেড়ে বলল, আরে এখানে মানে এই দেশে আমার এক মাস্তুতো দাদা থাকে গো দিদিরা।
পুচকি লাফিয়ে উঠল, মাস্তুতো দাদা? তাই নাকি?
-হ্যাঁগো দিদি। আমার এদেশের আত্মীয়। এ হল বুশ হাতি।
ওপরের হাতিদাদার সঙ্গে নিচে কার কী যেন কথা হল। হাতিদাদা নিচে নামতে লাগল। নামার আগে বলল, আইবসদা আমরা একটু নামছি।
আবিয়াসদা বলল, বেশ বেশ। তবে তোমাদের হয়ে গেলেই আমাকে ডাকবে কিন্তু।
-বটে তো। তুমি হলে এদেশে আমাদের গাইড।
কিন্তু একটা নরম নাটি দেখে নেমেছিল বলে তাদের কারোর কিছু ঝাঁকুনি লাগে নি। কিন্তু সামনে এতবড় এক হাতি দেখে সবাই তো থ। পুচকি আর তিতলি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছিল। দাদু নিচু গলায় বলল, এর নাম বুশ হাতি। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় হাতি। এর কান খুব বড় হয় তবে দাঁতগুলো বাঁকা হয়। আর এক রকমের হাতি আছে এদের বন হাতি বলে। এদের দাঁত কিন্তু সোজা। এই দাঁত কিন্তু হাতির অনেক কাজ করে দেয়। হাতি দাঁত দিয়ে কিছু চিবোয় না কারণ এদের চিবুবার দাঁত নেই। তাই এরা খুব নরম জিনিস খায়। এই শক্ত দাঁত দিয়ে গাছের গোড়া খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা গাছের নরম শেকড় বার করে খায়।
বুশ হাতি হাসিমুখে নেমে এসেছে। তারপর আমরা যেমন হাতে হাতে ঝাঁকানি দিয়ে করমর্দন কর ওরা তেমনি শুঁড়ে শুঁড়ে জড়িয়ে করমর্দন করল।
দাদু বলল, এই দুই হাতিদাদা কিন্তু এখন করমর্দন করছে। জানো তো তোমরা হাতির শুঁড়কে কর বলে। আবার আমাদের হাতকেও তাই বলে।
হাততালি দিয়ে উঠ্যল পুচকি খুব মজায়। সে তালির শব্দে বুশদাদা (বুশ হাতির দাদা সংস্করণ) এদিকে তাকালো কৌতূহলী হয়ে। হাতিদাদা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, আমাদের পুচকি আর তিতলিদিদি হচ্ছে সব পশুপাখিদের পরম বন্ধু। ওদের মত পশুপাখিদের প্রিয় আর কেউ হয় না।
বুশদাদা বেশ খুশি হয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, জানি তো ভাই সব জানি। এ সংবাদ আমাদের এখানেও এসে পৌঁছেছে। গ্রীফিন দাদা ইন্ডিয়া থেকে মেসেজ করে সবাইকে খবর দিয়েছে আমাদের সবার প্রিয়্ তিতলিদিদিরা বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। আমরা সবাই প্রস্তুত।
হাতিদাদাও খুশি হয়ে বলল, আর ওই যে উনি হলেন আসল লোক উনি আমাদের সবার প্রিয় দাদু। বস্তুত ওনার জন্যেই আমার পিঠে এই দুটো ডানা আর হাতি হলেও মাটির জীব হয়েও আমি আকাশে উড়তে পাচ্ছি।
______________________________________________________________________________________
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
181/44 জিটি রোড (গান্তির বাগান)
পোস্ট- বৈদ্য বাটি
জেলা -হুগলি।
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন