Featured Post

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৪ ।। জুলাই ২০২৫

ছবি
      সম্পাদকীয় ছোট্ট বন্ধুরা আশা করি তোমরা ভালো আছো। তোমরা তো জানো, বাংলার ঋতু বৈচিত্রে আষার-শ্রাবন বর্ষাকাল। একথাটা যেন আমরা ভুলতেই বসেছিলাম। পরিবেশ দূষণ আর আমাদের বিভিন্ন প্রযুক্তির যথেচ্ছ সীমাহীন ব্যবহারে আমরা প্রকৃতির মহিমা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যেটুকু বর্ষার ছোঁয়া পেতাম তা যেন ক্ষণিকের! গ্রীষ্মের সীমাহীন আস্ফালনের পর হঠাৎ-ই বর্ষা মিলিয়ে যেতে শীতের দিনকয়েকের আগমন। ফের গ্রীষ্মের দৌরাত্ম্য।কিন্তু এবারে যেন জাকিঁয়ে নেমেছে বর্ষা।রিমঝিম শব্দের মধুরতায় মন মোহিত হয়ে যাচ্ছে। তোমরাও নিশ্চয় উপভোগ করছো বর্ষার সৌন্দর্য্য। চারদিকের খালবিল, নালা-নদী জলে থৈ থৈ। সবুজের সমারোহ চারপাশে।এটাই তো কবিদের সময়, কবিতার সময়। মন-প্রান উজার করে লেখার সময়। পরাশুনোর ফাঁকে, বৃষ্টি-স্নাত বিকেলে তেলেভাজা মুড়ি খেতে খেতে তোমরাও বর্ষার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নিজেদের আবেগে ভাসিয়ে দাও লেখার খাতা। ধীরে ধীরে পরিণত হোক তোমাদের ভাবনার জগৎ। তবে বর্ষার ভালো দিকের সাথে সাথে তার ভয়াল রূপও রয়েছে । অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে  বন্যার আশঙ্কা থেকেই যায়। কত মানুষের কষ্ট, দূর্ভোগ বলো? সেই রকম বর্ষ...

বড় গল্প ।। মিনুর বড় হওয়া ।। শংকর ব্রহ্ম


ম্যাজিক ল্যাম্প: গল্প:: সোনাই আর পেঁচো - ঈশানী রায়চৌধুরী

মিনুর বড় হওয়া 

শংকর ব্রহ্ম


এক).
                   
                    মিনু মন খারপ করে জানলায় দাঁড়িয়েছিল। মা কোন সকাল বাবুদের বাড়িতে রান্না করতে গেছে, এখনও ঘরে ফিরল না কেন? সকালবেলা মা তাকে এক বাটি মুড়ি খেতে দিয়ে গেছিল। তা খাওয়া কখন শেষ হয়ে গেছে। এখন আবার তার ক্ষিদে পাচ্ছে। আজকাল তার খুব ক্ষিদে পায়। কেন কে জানে? মিনু জানে না। ক্ষিদে পেলে মিনুর খুব মন খারাপ হয়েে যায়। কাঁদতে ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে, চিৎকার করে। ঘরে এমন কিছু নেই যে খেয়ে সে পেট ভরাবে। তাই সে জানলা থেকে সরে এসে, প্লাসিকের বালতির থেকে মগে জল তুলে নিয়ে গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে খেল। এক গ্লাস জল ভরে খেয়ে ক্ষিদেকে বশ করার চেষ্টা করল। 
                       মিনুর ভাল নাম মিনতি মন্ডল। দেখতে রোগা পাতলা। কালোর মধ্য মুখখানা মিষ্টি। এক মাথা রুক্ষ কোঁকড়া চুল। চুলগুলি কাঁধ ছুঁয়েছে। মিনুর বয়স ছয় বছর। এখনও তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। এবার করে দেবে লক্ষ্মী ভেবেছে। লক্ষ্মী মিনুর মায়ের নাম। বাবার নাম গনেশ। গনেশ মন্ডল। লক্ষ্মী নাম দেখেই গনেশ তাকে বিয়ে করছিল। আগেও বিয়ের জন্য সে দু'একটা মেয়ে দেখে ছিল। পুঁটি, ননীবালা এইসব নাম তার পছন্দ হয়নি বলেই, বিয়েটা হয়নি। তারপর লক্ষ্মীকে দেখতে গিয়ে তার নাম শুনে, গনেশ ভেবেছিল লক্ষ্মী ঘরে থাকলে, সংসারে কোনও অভাব হবে না। 

                    জল খেতে খেতেই মিনুর চোখে পড়ল, তার মুড়ি খাওয়ার সময় যে কয়েকটা মুড়ি হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেছিল। মিনু আর সেগুলি মাটি থেকে তুলে খায়নি। কয়েকটা পিঁপড়ে এসে সেগুলি শুঁড় দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার, পিঁপড়েগুলি মুড়িগুলির থেকে ছোট হওয়া সত্ত্বেও কী সহজভাবে সেগুলি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের মধ্যে আগে আগে যে বড় পিঁপড়েটা যাচ্ছে, সেটা বোধহয় ওদের মা হবে, মিনু ভাবল। পিঁপড়েগুলি কোথায় যাচ্ছে দেখার জন্য মিনু তাদের পিছন পিছন যাচ্ছিল। এমন সময় তার মা ঘরে এসে ঢুকল। হাতে একটা প্লাসিকের ব্যাগ। তাতে নিশ্চয়ই কিছু খাবার আছে। মা রান্না-কাজের বাড়ি থেকে ফেরার সময় খাবার নিয়ে আসে। ওরা মাকে যে টিফিন খেতে দেয়, সেখানে বসে মা তা একা না খেয়ে, বাড়িতে নিয়ে আসে। মিনুকে দেয়, নিজেও খায়। বেশি থাকলে বাবার জন্য রেখে দেয়। বাবা তার ভ্যান-রিক্সা চালায়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ভ্যান-রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুপুরে বাড়িতে খেতে আসে। তার আগে একবার বাড়িতে বাজার করে দিয়ে যায়। মা কিছু টিফিন বাবার জন্য রাখলে, বাবা তখন তা খেয়ে যায়।
                    মা মিনুকে ডেকে বলল, মিনু মা, যা হাত মুখটা ধুয়ে এসে আমার কাছে বস। সে মিনুর জন্য একটা স্টিলের প্লেটে, প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট থেকে বের করে একটা লুচি আর আলুর দমের মধ্য থেকে তুলে দু'টুকরো আলু দিল। নিজেও একটা একটা স্টিলের প্লেটে লুচি আলুরদম তুলে নিয়ে, বাকিটা বাবার জন্য প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটের প্যাকেটটায় মুড়ে রেখে দিল। ওরা লুচি আলুরদম খেতে খেতে দেখল বাবা ভ্যান-রিক্সা নিয়ে ফিরে আসছে ঘরে। ঘরের জন্য চাল ডাল আর সবজি বাজার করে নিয়ে এসেছে।
                  খালপাড়ে পরপর অনেকগুলি বস্তি। তারই একটা বস্তিতে ওরা ভাড়া থাকে। নোংরা দুর্গন্ধময় পরিবেশ। তবু ভাড়া একটু কম হওয়ায় সেখানে ওদের মতো আরও অনেকে ভাড়া আছে। তারা কেউ বাজারে সবজি বেচে, কেউ কাঠের মিস্ত্রি।
কেউ আবার ট্রেনে-বাসে হকারী করে। একজন ব্রাহ্মণও আছে। নাম নকুল চক্রবর্তী। পাড়ার পুজো-আচ্চা, বিয়ে, অন্নপ্রাসনের কাজ সে-ই করে। গনেশের সঙ্গে লক্ষ্মীর  বিয়েটা দশ বছর আগে এই নকুল চক্রবর্তীই দিয়েছিল। তখন গনেশ দেখতে ছিল জোয়ান মদ্দ। দেখলে চোখ জুড়োত সকলের। আর লক্ষ্মী ছিল রোগা হালকা-পাতলা ফড়িংয়ের মতো ফুরফুরে একটি মেয়ে, ফ্রক ছেড়ে সবেমাত্র শাড়ি ধরেছে। মাথা ভর্তি কালো কোকড়া চুল একমাথা। চোখ দু'টি বড় বড় আর মায়াবী ধরণের ছিল তার, সেই মায়াময় চোখ দেখে গনেশ মজে ছিল বোধহয়।
                    তখন গনেশ একটা ফ্যান কোম্পানীতে কাজ করত। দোকানের অর্ডার অনুযায়ী কোম্পানী থেকে ফ্যান ভ্যান-রিক্সা করে নিয়ে গিয়ে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিত। আয় বেশ ভালই হত। বিয়ের দু'বছর পর কোম্পানীটা আচমকা লক-আউট করে উঠে যায়। তখন লক্ষ্মী একজন ধনী লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ নেয়। রান্না সে ভালই করতে পারে। বাবুরাও তার রান্না খেয়ে খুশি। পরের বছরে তারা, তার মজুরী পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দেয়। আগে পেত সাতশ' টাকা। এখন পায় সাতশ' পঞ্চাশ টাকা।
                  আর গনেশ ভ্যান-রিক্সা করে লোকের মাল বয়, তাতেও দিনে ষাট-সত্তর টাকার মতো আয় হয়। পাঁচশ-টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে, কোন রকমে সংসার চলে যায়।

                   গনেশ ভ্যান-রিক্সাটা বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে, হাতের বাজার লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই, লক্ষ্মী তাকে একটা একটা স্টিলের প্লেটে প্ল্যাস্টিক প্যাকেট থেকে, দু'খানা চুচি আর আলুরদম বের করে সাজিয়ে দিয়ে, তাকে খেতে ডাকল। বাবা এসে পা ভাজ করে বাবুহয়ে সযত্নে বসল, তারপর সাগ্রহে লুচি আলুরদম খেতে খেতে বলল, বাহ্, আলুরদমটা তো বেশ স্বাদ হয়েছে। তুমি রেঁধেছো বুঝি?
লক্ষ্মী তখন লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল তাকে। 
- আমাদের ঘরে একদিন এ-রকম আলুরদম রান্না কোরো তো।
- আচ্ছা, করব। বলে লক্ষ্মী হাসল।
গনেশ লুচি আলুরদম খেয়ে, হাত মুখ ধুয়ে, নিজের কাঁধের গামছাটা হাত মুখ মুছে, আবার রিক্সা-ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেল।
                   
                 লক্ষ্মী চাল ডাল সবজি ধুয়ে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে, তাতে একটা ছোট এলম্যুনিয়াম হাড়িতে চাল চড়িয়ে দিয়ে সবজিগুলি ভাজকরে রাখা একটা বটি বের করে, বটির ভাজ খুলে নিয়ে, সেটা পেতে সব্জিগুলি কেটে একটা প্ল্যাস্টিকের ঝুড়িতে রাখল। 
                ভাত ফুটে ওঠার পর, লক্ষ্মী হাতা দিয়ে হাড়ি থেকে দু'একটা ভাত তুলে নিয়ে দেখল, চাল ফুটে সিদ্দ হয়ে ভাত হয়েছে কিনা। ভাত হয়ে গেলে সে একটা এলম্যুনিয়ামের কড়াতে ডাল বসিয়ে দিল।
ডাল সিদ্দ হয়ে গেলে, ডালের কড়া নামিয়ে, 
একটা বাটিতে, ডালটা ঢেলে রেখে, ওই কড়াই ধুয়ে নিয়ে, ওতেই, তেল কিছুটা ঢেলে দিয়ে, তেল গরম হলে গেলে ফোঁড়ন ছেড়ে দিয়ে সবজি বসিয়ে দিল।

                    বাবা  বেরিয়ে যাবার পর মিনুর মনেহল, পিঁপড়েগুলির জন্য একটু লুচি আলুরদম রেখে দিলে ভাল হতো। খাওয়ার সময় সে কথা তার মনে পড়েনি। মনে পড়লে মিনু রেখে দিত নিশ্চয়ই।
- খুকি, তুমি খুব ভাল মনের মেয়ে।
কে যেন বলে উঠল, মিনু শুনতে পেল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, তার ধারে কাছে কেউ কোথাও নেই। তবে কে কথা বলছে?
মিনু তাই ভয়ে ভয়ে বলল, কে তুমি?
- আমি পিঁপড়ে মা। 
মিনু এবার মাটিতে নীচের দিকে তাকিয়ে বড় পিঁপড়েটাকে দেখতে পেল।
মিনু তাকে দেখে বলল, তুমি আমাকে বললে?
- তবে আর কাকে বলব।
মিনু এবার হেসে তাকে বলল, তোমার বাচ্চারা সব কোথায়?
- ওরা খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে।
- তুমি যাওনি?
 - যাচ্ছিলাম তো। তোমার মনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
 - তোমরা মনের সব কথা শুনতে পাও?
 - হ্যাঁ, পাই তো।
 - আমায় শিখিয় দেবে?
 - হ্যাঁ দেবো।
 - বাহ্, বেশ বেশ। মিনু হাত তালি দিয়ে উঠল। 
রান্না ঘরে থেকে চিৎকার করে জানতে চাইল, কী রে মিনু, হাত তালি দিচ্ছিস কেন?
মিনু তার কোন উত্তর না দিয়ে, হাত তালি দেওয়া থামিয়ে দিল।
পিঁপড়ে মা তখন বলল, এখন আমি যাই তাহলে। পরে এসে শিখিয়ে দেবো। বলে সে চলে গেল।
মিনু বলল, আবার এসো তুমি।
মা রান্নাঘর থেকে আবার জানতে চাইল, আবার কা'কে আসতে বলছিস, মিনু?
মিনু বলল, পিঁপড়ে মাকে?
- সে আবার কে? মিনুর মা, মিনুর কাছে জানতে চাইল।
- সে আছে একজন।
- কে সে?
- পিঁপড়ে মা।
- কোথায় থাকে?
- তা তো জানি না।

দুই).

                    বছরের শুরুতেই গনেশ মন্ডল মিনুকে নিয়ে গিয়ে কর্পোরেশন স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এল। সকালে স্কুল। মিড ডে মিলের ব্যবস্থা আছে। স্কুলে একবেলা খারার দেয়। সকালে বাড়িতে শুধু জল-মুড়ি খেয়ে এলেও এখানে এসে মিনুর ক্ষিদে পেলেই খাবার জুটে যায় বলে, এখন আর তার আগের মতো কান্না পায় না। বরং অন্যদের সঙ্গে তার আনন্দেই কাটে। অ আ পড়তে ভাল লাগে। এক দুই শিখতে ভাল লাগে। দীপা দিদিমণি তাদের সকলে খুব ভালবাসেন। পড়াবার সাথে সাথে মজার মজার গল্পও করেন। মিনুর তাকে পিঁপড়ে মায়ের কথা বলতে ইচ্ছে করে।  কিন্তু সংকোচে আর বলা হয়ে ওঠে না।
                         এইভাবে মিনুর বছরখানেক কেটে যায় কর্পোরেশন স্কুলে।
এখানে তার পড়াশুনা করতে ভালই লাগে। 
দীপা দিদিমণির মুখে একদিন সে শুনেছিল একটা ছড়া। ছড়াটা শুনতে তার ভাল লেগেছিল। ছড়াটা শেষের লাইনগুলি তার মনে আছে। 
"পিপীলিকা, পিপীলিকা,
দল-বল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।''

"শীতের সঞ্চয় চাই,
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিল পিল চলি।''

মিনু দীপা দিদিমণির কাছে জানতে চেয়েছিল, 'পিপীলিকা' মানে কি দিদি?
- 'পিপীলিকা' মানে পিঁপড়ে। দীপাদি বলেছিল।

                    ক্লাস টু-তে উঠে মিনু জোড় বিজোড় সংখ্যা চেনে। যোগ বিয়োগও শিখে গেছে। স্কুল থেকে সে এগারোটায় বাড়ি চলে আসে। মিনুর মা তখন রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে। একদিন লক্ষ্মী রান্নাঘরে রান্না করতে এসে দেখল, ঘরে হলুদ নেই। নিজেই দোকানে যাবে ভেবেছিল, এমন সময় সে মিনুকে স্কুল থেকে ফিরে আসতে দেখে, বলল, মা দোকান থেকে এক প্যাকেট হলুদগুড়ো কিনে আনতে পারবি?
- কেন পারব না মা। বলে সে তার মায়ের হাতে স্কুল ব্যাগটা দিয়ে, মার হাত থেকে দশ টাকার নোটটা হাতে নিল। 
লক্ষ্মী বলল, হলুদের দাম সাত টাকা।
মিনু বলল, তবে তিন টাকা ফেরৎ আনব মা।
- তুই কি করে জানলি?
মিনু রহস্যের হাসি হেসে বলল, আমি জানি।
- কি করে, বল?
- স্কুলে শিখেছি।
লক্ষ্মী শুনে খুশি হয় খুব। ভাবে মেয়েটার পড়াশুনায় বেশ মন আছে।
                      সামনের বছর মিনু থ্রী-তে উঠবে। সামনের ডিসেম্বরে পরীক্ষা। বাতাসে হিমের ছোঁয়া লেগেছে। শীত পড়তে দেরি নেই।
                    একদিন মিনু বসে বসে যোগ বিয়োগ করছে। এমন সময় দেখল একটা পিঁপড়ে এতা একা কোথায় যাচ্ছে। সে সুর করে বলে উঠল -
"পিপীলিকা, পিপীলিকা,
দল-বল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।''
মিনু এইটুকু সবে বলা শেষ করেছে। তখনই
আশ্চর্য হয়ে মিনু শুনল পিঁপড়েটা তার সুরে বলে উঠল -
"শীতের সঞ্চয় চাই,
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিল পিল চলি।''

                   কথাগুলি সত্যি  সত্যি পিঁপড়েটা বলল কিনা, মিনু তা বুঝবার আগেই পিঁপড়েটা তরতর করে চলে গেল।
এই কথাটাও একদিন স্কুলে দীপাদি বলতে হবে, মিনু মনে মনে ভাবল।


তিন).

                  খাল সংস্কারের কারণে, সরকারী নোটিশে খাল পাড়ের বস্তি উচ্ছেদের কাজ শুরু হবে। এখান থেকে সকলকে উঠে যেতে হবে। মিনতিদেরও সকলের মতো উঠে যেতে হবে। লক্ষ্মী গনেশের মাথায় হাত পড়েছে। তারা জানে না, এখন কোথায় উঠে যাবে? গনেশ যাকে কাছে পাচ্ছে, তাকেই ডেকে জিজ্ঞসা করছে, আচ্ছা বাচ্চু ভাই, কিংবা কালু ভাই, কোনও সস্তার ভাড়াঘর তোমার জানা আছে?
- কতটাকার মধ্যে?
- চার পাঁচশ' টাকার মধ্যে।
- ধুর। ওই টাকায় একচিলতে বারান্দাও ভাড়া পাবে না।
- কত টাকা লাগবে তাহলে?
- দেড় দুহাজারের কম, কোথাও ঘর পাবে বলে মনেহয় না। গনেশ ভাবনায় পড়ে, এতটাকা সে দেবে কোথা থেকে? এ নিয়ে লক্ষ্মীর সাথে কথা বলে দেখতে হবে, সে মনে মনে ভাবে।

                    মিনতি ভাবে বস্তি ঘরগুলি সব ভেঙে দিলে, মানুষগুলি না হয়, অন্য কোথাও চলে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেবে। কিন্তু, পিঁপড়েরা সব কোথায় যাবে? সে ভেবেছিল কথাটা একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু তাকে আর জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি।
এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম ভাঙলে পরে সে দেখল, তাদের  ঘরের সব মালপত্র বাবার ভ্যান-রিক্সায় তুলে দেওয়া হয়েছে। বাবা মা নিজেরাও ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মিনুকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে, তাকে কাছে ডেকে নিয়ে মা তার চোখ মুখ ধুয়িয়ে দিল। তারপর এক বাটি মুড়ি দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমাদের এবার এখান থেকে রওনা দিতে হবে।
মিনু মুড়ি খেতে খেতে দেখল, পিঁপড়েগুলি এক এক করে এসে তাদের ভ্যান-রিক্সায় উঠে, তাদের ঘরের মালপত্রের সঙ্গে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। মা বাবা অন্যদিকের কাজে ব্যস্ত, তাই এসব আর তাদের চোখে পড়ছে না। মিনু মুড়ি খেতে খেতে ভাবল, এসব তাদের চোখে না পড়ে, ভালই হয়েছে। চোখে পড়লে হয়তো ওরা পিঁপড়েগুলিকে বাবার কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে বা অন্য কোনও জিনিষ দিয়ে ভ্যান-রিক্সা থেকে ঝেড়ে নীচে ফেলে দিত।

                    মার ডাকে মিনুর ঘুমটা ভেঙে গেল। মিনু ভাবল, এসব তবে সত্যি নয়। এতক্ষণ মিনু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। 
সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে বৃষ্টি ছিল না। মিনু স্কুলে যাওয়ার পথে দেখল, রাস্তার পাশে কচুগাছের পাতার উপরে জলের মুক্তোদানা ভাসছে। মিনু সেগুলি দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। কোথা থেকে কয়েকটা ফড়িং উড়ে এসে, একটা কচুপাতার উপর বসতেই, মুক্তদানা গুলি যেন ভয়ে নীচে ঝরে পড়ল। 
এমন সময় মিনুদের ক্লাসের নীলা এসে পিছন থেকে বলল, কিরে স্কুলে যাবি না? চল।
                    মিনুর ফড়িংগুলির কান্ড না দেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না। স্কুলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে সে অনিচ্ছায় নীলার সঙ্গে স্কুলের দিকে চলল। চোখে তখনও মিনুর কচুপাতার উপরে পড়ে থাকা জলের মুক্তোদানাগুলি ভাসছিল।

চার).

                     গনেশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, বাজারের ভিতর যে দোকানটায় গুড়, বাতাসা, মুড়কি তৈরী হত, সেই দোকানের মালিক হরিদাস সামন্ত ছ'মাস আগে মারা যাওয়ায় দোকানটা এখন বন্ধ আছে। তার ছেলে রুইদাস দোকানটা ভাড়া দেবে বলে শুনতে পেয়ে, গোপাল ঘরে এসে লক্ষ্মীর সাথে সে ব্যাপারে পরামর্শ করল। 
লক্ষ্মী শুনে বলল, বেশ তো। তার সাথে কথা বলে দেখ কত ভাড়া চায়?
- আচ্ছা। দোকানটা ভাড়া নিলে সেখানে থাকা যাবে?
- যাবে না কেন?
- বাজারের ভিতর বলে?
- বাজারের ভিতর বলে ভালই হবে। ভিতরের দিকে একটা আড়াল করে নিয়ে থাকব। আর সামনের দিকে খাবারের দোকান দেব। সকালে লুচি, আলুর দম, ঘুগনি, পাওরুটি, চা-বিস্কুট আর দুপুরের দিকে - ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস রাখব। বাজারের ভিতর ভালোই চলবে মনেহয়।
গোপাল শুনে বলে, আর তোর বাবুর বাড়ির কাজ?
- ছেড়ে দেব। নিজে ব্যবসা করব।
- কী বুদ্ধি তোর লক্ষ্মী। বলে গনেশ তাকে গভীর চোখে দেখে।
- অমন ভাবে তুমি দেখছো কি?
- তোকে।
- আমাকে নতুন দেখছো নাকি?
- হুম।
- ঢঙ্। লক্ষ্মী ঠোঁট উলটালো।
- ভাবছি তোর এতটুকু মাথায় যা বুদ্ধি, আমার এত বড় মাথাটায় তার কণা মাত্র নেই কেন? গনেশ বলল।
শুনে, হি হি করে হেসে উঠল লক্ষ্মী।

                  পরদিনই গনেশ রুইদাসের সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করল। দোকানটা ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে খোলামেলা ভাবে তার সাথে আলোচনা করল। রুইদাস তার সব কথা শুনে গনেশকে বলল, দোকান ঘরের জন্য তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হবে। আর মাসে মাসে দেড় হাজার টাকা ভাড়া লাগবে আমার।
গনেশ শুনে বিনিতভাবে তাকে বলল, রিক্সা-ভ্যান চালিয়ে খাই বাবু। আপনি তো জানেন সবই। এতটাকা আমি পাব কোথায়?
রুইদাশ গনেশকে ভালভাবে জানত। সৎ এবং নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী লোক। তাই সে গনেশকে বলল, তুমি কত দিতে পারবে?
- অগ্রিম তিন হাজার, আর মাসে মাসে একহাজার ভাড়া হলে ভাল হয় আমার পক্ষে।
- বেশ। তবে তুমি তাই দিয়ো। কবে থেকে দোকান নেবে?
- সামনের মাস থেকেই।
- বেশ। বেশ।
- আজ তবে আসি বাবু?
- হ্যাঁ, এসো।

                  পরের মাস থেকেই বাজারের ভিতর হোটেল চালু হয়ে গেল। গনেশ একটা সাইনবোর্ড লিখিয়ে এনে দেকানের সামনে টাঙিয়ে দিল - 'লক্ষ্মীর হোটেল'।

                  ভোরবেলা উঠে লক্ষ্মী হোটেলের ঝাঁপ তোলে। উনোনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, কেতলিতে চায়ের জল বসিয়ে দেয়। তার মধ্যেই দু'একজন করে চায়ের খরিদ্দার আসতে শুরু করে। লক্ষ্মী একা হাতেই তাদের সামলায়।

                   প্রথমদিকে কয়েকদিন সকালবেলা মুড়ি খেয়ে মিনু স্কুলে চলে যায়। গনেশ রিক্সা-ভ্যান নিয়ে ভাড়া খাটতে বেরিয়ে যায়। ভাড়া না থাকলে গনেশ মাঝে মাঝে এসে লক্ষ্মীকে হোটেলের কাজে সাহায্য করে। 
                    লক্ষ্মীর হাতের রান্না ভাল। তার ব্যবহারও মিষ্টি মধুর। ফলে দোকানটা একবছরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায়। গনেশও আজকাল রিক্সা-ভ্যান কম চালায়। বেশিরভাগ সময়টাই লক্ষ্মীর সঙ্গে হোটেলের কাজে ব্যয় করে।
                     আজকাল মিনুর আর শুকনো মুড়ি খেয়ে স্কুলে যেতে হয় না। চা দিয়ে পাওরুটি টোষ্ট খেয়ে যায়। আজকাল আর মিনুর ক্ষিদের জন্য কান্না পায় না। সে বড় হয়ে গেছে। এখন সে ক্লাস থ্রীতে পড়ে। সামনের বার সে ক্লাস ফোরে উঠবে।
                       পিঁপড়েরা সব এখন কোথায় আছে, কেমন আছে? মিনু জানে না। এখন আর তার পিঁপড়ে-মার সঙ্গে দেখা হয় না। তার কাছ থেকে মিনুর আর মানুষের মনের কথাটা জানার বিদ্যে শেখা হয়নি। শেখা থাকলে হোটোলে যে সব খরিদাররা খেতে আসে তাদের মনের কথা মিনু জানতে পারত। তা আর এখন সম্ভব নয়। তখনই কেন সে পিঁপড়ে-মার থেকে মনের কথা জেনে নেওয়ার বিদ্যেটা, শিখে নিল না, এইজন্য এখন তার খুব আপসোস হচ্ছে মনে মনে। 
                    দীপাদি সেদিন ক্লাসে হোমটাক্স প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কাজ ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখবে না। যে কাজটা কাল করার কথা, সেই কাজটা আজই করবে। আর যে কাজটা আজ করার কথা, সেই কাজটা এখনই করবে। দীপাদি ঠিকই বলেছিলেন।

______________________________________________________________________________________
 

 

শংকর ব্রহ্ম
৮/১ আশুতোষ পল্লী,
পোষ্ট-গরিয়া,

কলকাতা - ৭০০০৮৪.


[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]


মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৪ ।। জুলাই ২০২৫

ছড়া ।। কেলে গাইটা ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৩ ।। জুন ২০২৫

কবিতা ।। এখন ।। সুশান্ত সেন

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪২ ।। মে ২০২৫

ছড়া ।। বাঘের থাবায় কাঁটা ।। প্রবীর বারিক

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪০ ।। মার্চ ২০২৫

থ্রিলার গল্প ।। লাশ কাটার ঘর ।। ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

গল্প ।। ডেডলক ।। ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪২ ।। মে ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৩ ।। জুন ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৪ ।। জুলাই ২০২৫

ছড়া ।। কেলে গাইটা ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

ছড়া ।। তাপের বহর ।। রঞ্জন কুমার মণ্ডল

গল্প ।। মামা বাড়ি ভারি মজা ।। মিঠুন মুখার্জী

কবিতা ।। এখন ।। সুশান্ত সেন

ছোটদের আঁকিবুঁকি ।। ত্রিত্বারিংশ সংখ্যা ।। জুন, ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪০ ।। মার্চ ২০২৫

ছড়া ।। ফিরে দেখা ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪০ ।। মার্চ ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪১ ।। এপ্রিল ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪২ ।। মে ২০২৫

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ,39th issue: February 2025

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। পঞ্চত্রিংশ সংখ্যা ।। আগষ্ট ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ষড়ত্রিংশ সংখ্যা ।। সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় ৪৩ ।। জুন ২০২৫

কবিতা ।। আকাশ-সাগর ।। শান্তনু আচার্য

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022