বহুরূপী
অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)
সাদা পাঞ্জাবি পরা মাথায় বিরাট পাগরি মাথায় একটা মূর্তি। একভাবে দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে।একদল মানুষ ঘিরে রেখেছে তাকে। আমি দূর থেকে দেখছি। ক্রমশ ভীড় বাড়তেলাগলো।
মূর্তিটা অবিকল রাজা রামমোহন রায়।
বছর শেষে ডায়মন্ড হারবার ইকো পিকনিক স্পটে সুন্দর একটা মেলা বসেছে। সেই মেলাতেই এমন দৃশ্য। আমরা গিয়ে ছিলাম নদীর পাড়ে পিকনিকে। সেখানেই এই মেলা। নানা স্থান থেকে মানুষের ভীড় উপচে পড়েছে।
কিন্তু একটু অবাক লাগল। একটু আগে ও এখানে এই মূর্তিটা ছিল না। হঠাৎ এলো কোথা থেকে?
কৌতূহল আর সামলাতে পারলাম না। ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। মূর্তির নীচে কাগজে বড় করে লেখা আছে রাজা রামমোহন রায়। যেন জীবন্ত এক ব্যক্তিত্ব। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এই ব্যক্তির সেই মূল্যবান কর্মসূচি। কত কঠিন পরিস্থিতিতে সমাজের নারীদের কথা ভেবে সতীদাহ প্রথা লোপ করে ছিলেন। আজকাল হয়তো কেউ আর মনেই রাখে না এমন মানব বন্ধুকে।
অথচ সেই মূর্তি দেখার জন্য এত ভীড়! সেই সঙ্গে হাততালি । সেল্ফি তোলার ধূম। কেউ ভিডিও করছে। কেউ বা ক্যামেরাবন্দী করে রাখছে। চোখদুটো চকচক করছে ঠিক জীবন্ত মানুষের মতো।
একজন চেঁচিয়ে উঠলো, ওই দেখ চোখের পাতাটা কেঁপে উঠল মনে হয়। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। দূর বোকা। মূর্তি আবার নড়ে নাকি?
আর একজন বলল,ওই দেখ আবার নড়ছে।
এখানকার একজন মানুষ হাসতে হাসতে বললেন, আরে এ তো আমাদের গনেশ বহুরূপী। এমনি করেই মানুষের মন ভোলায়।
এতে ওর আনন্দ। কখনো রবি ঠাকুর, কখনো নজরুল আবার কখনো মহাদেব সেজে মানুষকে আনন্দ দেয়। পারিশ্রমিক হিসাবে সামান্য কিছু টাকা।
পুরস্কার হিসাবে জনগন তুলে দেয় ওর হাতে। তাতেই খুশি। সেপটিপিন গেঁথে ২০টাকা, দশ টাকার নোট গেঁথে দিচ্ছে কাদা মাখা ময়লা পাঞ্জাবিতে। সারা গায়ে বালি কাদা মাখা। হাতে ধরে রেখেছে কাদা মাখা মোটা একটা পুঁথি। যা রামমোহনের হাতে ধরা থাকতো।
আমি কোনো দিন বহুরূপী দেখিনি। এমন ভাবে যে কেউ মনের খুশিতে ইচ্ছে মত অন্যের রূপ ধারণ করতে পারে। ভাবতেই পারি নি।
বেশ কিছু টাকার নোটে ভরে গেল পাঞ্জাবি। কিছুক্ষণ পরে উঁচু থাম থেকে নেমে ধীর পায়ে ফিরে গেল গন্তব্যের দিকে।
আমিও একটা সেল্ফি তুলতে পিছু নিলাম। ডাকলাম, ও রামমোহন কাকু। একটু দাঁড়াও। একটা ছবি তুলি। বহুরূপী অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাছে গিয়ে বললাম, আপনি বহুরূপী সাজতে ভালোবাসেন। অভিনেতা হলেন না কেন? বেশ তো অভিনয় করছেন।
একটু মুচকি হেসে বললেন, অভিনয় করতে টাকা লাগে,বোন টাকা। আমার তো কিছু নেই। কেউ নেই। এই বেশ আছি। হা হা হা।এই বেশ আছি। বলতে বলতে চলে গেলেন।
যদিও শুনলাম,রোজগারের পুরো টাকাটা গনেশ পায় না। মেলা কমিটির ও ভাগ আছে। তবু তাতেই খুশি গনেশ বহুরূপী।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বোন পরের দিন রবীন্দ্রনাথকে দেখতে আবার এসো কেমন। আমি গনেশ বহুরূপী। এই ভালো আছি।
______________________________________________
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন