উপহার
শ্যামল হুদাতী
চিঠিটা নিয়ে যান.....আমাকে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? চিঠিটা দয়া করে নিন - আমাকে ছাড়ুন... অনেক বাড়ি যেতে হবে...অনেক কাজ বাকি।
-'আমি আসছি... একটু অপেক্ষা করুন।' ভিতর থেকে একটি মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসলো।
ডাকপিয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরও পাঁচ ছয় মিনিট। কিছুটা অসহিষ্ণু গলায় বললেন, 'আমাকে আরও অনেক বাড়ি যেতে হবে। একটু তাড়াতাড়ি আসুন।'
ভেতর থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসলো, 'চিঠিটা দরজার পাশে রেখে চলে যান। আমার আসতে আর একটু সময় লাগবে।'
সামান্য বিরক্ত হয়ে ডাকপিয়ন বললেন, 'চিঠিটা রেজিস্টার্ড পোস্ট। এতে সই করা আবশ্যক।'
অল্প কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল। কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথেই পিয়ন বাবু অবাক হয়ে গেলেন। তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক প্রতিবন্ধী মেয়ে যার দুটো পা নেই। দেরি হবার জন্য এত রাগ ও বিরক্ত সব যেন উবে গেল।
মেয়েটি খুব নিরীহভাবে পোস্টম্যানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ' আমার চিঠিটা দাও। কোথায় সই করতে হবে, বলুন?'
-'এখানে সই করো, মা।' পিয়নবাবু চিঠিটা দিয়ে চলে গেলেন।
প্রতিবন্ধী মেয়েটির বাবা কাজের জন্য বাইরে যেতেন। তার মা ছিলেন না। প্রায়ই তার বাড়িতে একা থাকতে হতো । যদিও সকাল সন্ধ্যায় এক কাজের মেয়ে তাকে দেখাশোনার জন্য থাকতো। মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে একা একাই থাকতে হতো।
মাসে একবার কিংবা দুবার সেই মেয়েটির ঠিকানায় রেজিস্টার্ড পোস্ট আসত। পিয়নবাবু মেয়েটিকে ডাকতেন এবং না আসা পর্যন্ত শান্তভাবে দরজায় তার জন্য অপেক্ষা করতেন।
মাসে একবার কিংবা দুবার চিঠি আদান-প্রদান কাজে পিয়নবাবুর সাথে মেয়েটির বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।
হঠাৎ একদিন মেয়েটি চোখে পড়ল, পিয়নবাবু খালি পায়ে চলাফেরা করেন। হয়ত কেনার পয়সা হয়নি। খালি পায়েই চিঠি বিলি করেন।
তারপর একদিন পিয়নবাবু এসে ডাক পৌঁছে দিয়ে চলে গেলে মেয়েটি ভেজা কাদায় পিয়নবাবুর পায়ের ছাপের ওপর একটা কাগজ রেখে সেই পায়ের ছাপের ছবি তুলল। পরের দিন তিনি তার বাড়ির কাজের মেয়েকে ওই সাইজের জুতা কিনে আনতে বলে সেগুলো তার বাড়িতে রাখল।
দীপাবলি আসার ঠিক আগে পিয়নবাবু উৎসবের জন্য এলাকার সমস্ত লোকের কাছে বখশিস চাইল। কিন্তু সে ছোট্ট মেয়েটির কথা ভেবেছিল, 'আমি কেন পঙ্গু মেয়েটির কাছে বখশিস চাইব, কিন্তু যেহেতু আমি রাস্তায় এসেছি, আমার অন্তত তার সাথে দেখা করা উচিত।'
পিয়নবাবু ভাবতে লাগলেন, 'উৎসবের সময় একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে খালি হাতে দেখা ঠিক হবে না। পাঁচ টাকা দামের একটি চকলেট কিনলেন।'
এরপর মেয়েটির বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেন তিনি।
ভেতর থেকে একটা আওয়াজ এল..."কে?
"এটা আমি, ... তোমার পিয়নচাচা"... উত্তর দিলেন।'
মেয়েটি এসে দরজা খুললে পিয়নবাবু তার হাতে একটা চকলেট দিয়ে বলল, 'এটা তোমার গরিব চাচার কাছ থেকে নাও।'
মেয়েটি খুব খুশি হল এবং পিয়নচাচাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল।
তার পরে সে তার বাড়ির ভেতর থেকে একটি বড় বাক্স নিয়ে এসে পিয়নকাকুর হাতে দিয়ে বললেন, "কাকা... এটা আমার পক্ষ থেকে দীপাবলিতে তোমার জন্য একটি ছোট্ট উপহার।"
পিয়নকাকু বাক্সটা দেখে খুব অবাক হয়ে গেলেন। কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললেন, 'তুমি আমার মেয়ের মতো, তোমার কাছ থেকে কোন উপহার আমি কিভাবে গ্রহণ করব?'
- "চাচা, এই উপহারটি দয়া করে প্রত্যাখ্যান করবেন না .....আমি প্রচন্ড দুঃখ পাবো।"
"ঠিক আছে", এই বলে পিয়নকাকু প্যাকেটটা নিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের করলেন।
মেয়েটি বলল, "চাচা, একটা অনুরোধ এই প্যাকেটটি আপনার বাড়িতে পৌঁছে তবেই খুলবেন।"
বাড়িতে পৌঁছে পোস্টম্যান প্যাকেটটি খুলে অবাক হয়ে গেলেন কারণ এতে এক জোড়া জুতো ছিল এবং উপহারটি পেলাম এমন একজনের কাছ থেকে যার পাদুটোই নেই।। তার চোখ জলে ভরে উঠল।
পিয়নবাবু বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে একটি ছোট্ট মেয়ে তার খালি পায়ের জন্য এতটা উদ্বিগ্ন হতে পারে।
পরের দিন পিয়নবাবু তার পোস্ট অফিসে পৌঁছে পোস্টমাস্টারকে অবিলম্বে তাকে অন্য এলাকায় বদলি করার অনুরোধ জানালেন।
পোস্টমাস্টার এর কারণ জিজ্ঞেস করলে, পোস্টম্যান সেই জুতোগুলো টেবিলে রেখে পুরো ঘটনা খুলে বলল এবং ভেজা চোখে ও বললেন,
"স্যার... আজ থেকে আমি ওই রাস্তায় যেতে পারব না। সেই ছোট্ট প্রতিবন্ধী মেয়েটি আমার খালি পায়ে জুতা দিয়েছে কিন্তু আমি কীভাবে তাকে আমার পাদুটো দিতে পারব যা হবে সমতুল্য উপহার ?" একথা বলে ডাকপিয়ন অঝোরে কাঁদতে লাগল।
____________________________________________
শ্যামল হুদাতী
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড,
কলকাতা ৭০০০৬৮
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন