মেজমামার বেলুন ভ্রমণে বিপত্তি
অঞ্জনা মজুমদার
ঋভুর মেজমামাকে আমরা সবাই চিনি। স্কুলের হেডস্যরও স্বীকার করেন বিনুবাবু খুব বড় বিজ্ঞানী। আমেরিকা থেকে দেশের টানে, মা বাবার টানে ফিরে না এলে বিনুবাবুর নোবেল প্রাইজ পাওয়া কেউ আটকাতে পারত না। অবশ্য মেজমামা পুরস্কারের পরোয়া করেন না। গ্রামের কলেজে ফিজিক্স পড়ান। প্রায়ই নিজের এক্সপেরিমেন্ট এর কাজে কলেজ যেতে ভুলে যান। প্রিন্সিপ্যাল স্যর তখন দাদুভাই এর মোবাইলে না হলে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করে মেজমামার ক্লাস এর কথা মনে করিয়ে দেন। তবে একবার কলেজে গেলে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্ক সব ক্লাস পরের পর করেই চলেন। এতে ছাত্রছাত্রীরা খুব খুশি হয়।
ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ করে মেজমামার নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা শুনতে খুব পছন্দ করে। তবে মেজমামা তার নতুন আবিষ্কারের কথা সর্বপ্রথম ঋভু আর মিনিকে বলতেই পছন্দ করেন।
কাল রাতে ডিনার টেবিলে মেজমামা ঋভুকে চুপিচুপি বললেন, খাওয়া সেরে ল্যাবে আসিস, কথা আছে।
ঋভু আর মিনি উত্তেজিত। মেজমামার কথা মানেই অ্যাডভেঞ্চার। ইদানিং রোবুও ওদের সঙ্গী হয়েছে। আর ভুলু কুকুর তো মিনির পায়ে পায়ে ঘোরে।
রাতে দিদুন ঘুমিয়ে পড়লে ওরা তিনজন মামার ল্যাবরেটরিতে।
মেজমামা বললেন, আয় কাল রাস পূর্ণিমা। আমরা কাল বেলুনে চড়ে আকাশে বেড়াতে যাব।
রোবু গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু বেলুন ওড়াতে গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আগুন জ্বালাতে হয়। আগুন নিয়ে খেলা ভালো নয়।
মেজমামা রেগে বললেন, তুই বেশি কথা বলবি না। আমার বেলুন গ্যাস জ্বালিয়ে উড়বে না। এটা ইলেকট্রনিকস্ এর যুগ। আমি এমন ইঞ্জিন তৈরি করেছি যা জল দিয়ে চলবে।
ঋভু বলল, রোবুর কথা বাদ দাও। দেখাও বেলুনটা।
মেজমামা আঙুল দেখালেন ছাদের কোণে একটা মস্ত ঝুড়ি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা একটা লাল বেলুনের সাথে।
মিনি বলল, কখন উঠবো আমরা বেলুনে?
কাল রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে,আকাশে চাঁদ থাকবে।
না না, মিনি বলল এখনই তো চাঁদ রয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
বলেই সে ঝুড়িতে চড়ে বসল।
মিনির জেদের কাছে সব্বাই হেরে যায়। অগত্যা মেজমামা বললেন, আয় তবে সবাই উঠে পড়।
ঋভু, রোবু ভুলু মেজমামা উঠে বসতেই মেজমামা একটা সুইচ টিপতেই বেলুন ধীরে ধীরে ফুলে উঠল আর তারপরই অবাক কান্ড, সোজা আকাশে উড়ে গেল।
ওপরের ঠান্ডা হাওয়ায় শীত করতে লাগল। কিন্তু ঋভু মিনি পাত্তা দিল না। তারা উত্তেজিত আকাশ ভ্রমণে। মিনি বলল, দাদা দেখ দেখ নীচে নদী দেখা যাচ্ছে। আর দূরে কত ঘন জঙ্গল!
মেজমামা বললেন, ওটা ইছামতী নদী আর দূরে সুন্দরবন।
মিনি বলল, মামু সুন্দরবনে তো রয়াল বেঙ্গল টাইগার থাকে তাই না?
মেজমামা কিছু বলার আগেই বেলুনের গতি কমে এল। আর নদীতীরে নেমে এল বেলুন।
ঋভু বলল, এখানে নামল কেন? এখানে একপাশে নদী, কুমীর হাঙর ভর্তি আর একপাশে জঙ্গলে হিংস্র জন্তু জানোয়ার।
মেজমামা সুইচ টেপাটেপি করছেন। তার হতাশ মুখ দেখে মনে হচ্ছে বুঝতে পারছেন না যন্ত্রে কি গোলমাল।
ইতিমধ্যে মিনি লাফ দিয়ে ঝুড়ি থেকে নেমে পড়েছে। বোনকে ডাকতে ডাকতে ঋভু আর ভুলু। মিনি চাঁদের আলোয় নদীতীরে ছোটাছুটি করছে আর তাকে ধরতে ঋভু।
হঠাৎই জঙ্গলে পাখিদের কিচিরমিচির আর তারপরই গম্ভীর বাঘের ডাক। সেই ডাকে চমকে গিয়ে মেজমামা ঝুড়ির নীচে উল্টে পড়ে গেলেন। ভাই বোন ছুটে এল মামাকে তুলতে। ভুলু জোরে জোরে ঘেউঘেউ করে ডাকতে লাগল। জঙ্গলে সব চেঁচামেচি থেমে গেল।
মামার হাতের জোরালো টর্চ জ্বলে উঠল জঙ্গলের দিকে ফোকাস করে। দুটো জ্বলজ্বলে চোখ এক লহমায় জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। আবার বাঘের ডাক আর একটা হুটোপুটি। কে যেন জোরে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
গোটা ঘটনাটি ঘটেছে কয়েক মিনিটে। চারিদিক নিশ্চুপ। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙল রোবুর রিনরিনে গলার আওয়াজে।
ঋভুদাদা উঠে এসো। বেলুনের সুইচ মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে।
সবাই হুড়মুড় করে ঝুড়িতে উঠে পড়ল।
মেজমামা সুইচ এর কাছে গিয়ে রোবুকে বললেন, কি হয়েছিল?
রোবু বলল, মনে হয় এই স্ক্রু দুটো লুজ হয়ে গিয়েছিল। আমি টাইট করে দিয়েছি। বলেই সে একটা সুইচ টিপল।
আবার বেলুন হু হু করে ওপরে উঠতে শুরু করল। মিনি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু বেলুন নদীর ওপারে যাচ্ছে।
ঋভু আঁতকে উঠে বলল, মেজমামু ওপারে তো বাংলাদেশ। ওপারের সেনারা আমাদের বেলুন দেখতে পেলে যদি গুলি করে দেয় ? ভারতীয় সেনারাও আমাদের আক্রমণ করতে পারে।
মেজমামা বিপদ বুঝতে পারলেন। রোবুর দিকে হতাশ হয়ে তাকালেন।
রোবু বিভিন্ন সুইচ টেপাটেপি করে বেলুনের গতি নদীর এপারেই রাখতে পারল। তবে গতিবেগ কমল না। হু হু করে উড়েই চলছে। ঋভুদের স্কুল, মেজমামার কলেজ চলে গেল। বাড়ির ওপর দিয়ে যাবার সময় মিনি বাড়ি ফিরে যাবো বলে কান্না জুড়ে দিল।
রোবু কি সুইচ টিপল কে জানে? বেলুন বাড়ির পাশে খেলার মাঠের ওপর মাঠের চারপাশে পাক খেতে লাগল।
ভোরের সূর্য মামা আকাশের কোণে উঁকি দিচ্ছেন। মিনির কান্না বেড়ে চলেছে। মেজমামা মাথায় হাত দিয়ে ঝুড়ির মেঝেতে বসে পড়েছেন।
হঠাৎই রোবুর গলা, ঋভুদাদা ওই পাশের হাতলটা টেনে দেখ তো! আমি এই সুইচটা টিপে আছি। মেজমামা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ঠিক ঠিক, এটাই করতে হবে বেলুন নামাতে হলে।
ধীরে ধীরে বেলুন নামল মাঠে। কিন্তু মাঠের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালের খোঁচা লেগে বেলুনের কাপড়ে ফুটো হয়ে গেল। বেলুনের কাপড়ে ঢাকা পড়ে গেল ঝুড়ির সবাই।
মাঠের মধ্যে বেলুন নামতেই মর্নিং ওয়াকের দলবল ঝুড়িকে ঘিরে ধরল। মিনির কান্না আর ভুলুর ঘেউঘেউ তো ছিলই। তারাই বেলুনের কাপড় সরিয়ে সবাইকে উদ্ধার করলেন। মনিদিদা বললন, বিনু তোর তৈরি বেলুন এটা? আমাদের একদিন এতে করে তারকেশ্বর নিয়ে যাবি?
দাদুভাই বললেন, তোমরা বাড়ি ছিলে না? বেলুনে চড়ে বেড়াতে গিয়েছিলে? বিনুর নতুন কীর্তি?
মেজমামা, ঋভু, রোবু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কেবল মিনি দাদুভাই এর হাত ধরে টেনে ধরল, বাড়ি যাবো দাদু।
দাদুভাই মিনির হাত ধরে বাড়ির দিকে চললেন। সবাই বাড়ি চলো।
মেজমামা মাথা নিচু করে বাড়ির পথ ধরলেন।
বেলুন যাত্রার শেষে ঋভু চিন্তিত। কেবল রোবু খুশি। মৃদুস্বরে বলল, ঋভুদাদা বেলুন আবার উড়বে। এবারের এক্সপেরিমেন্ট পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। তবে আর একটু সতর্ক থাকতে হবে। ভুলু গলা খুলে ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠলো যেন রোবুকে সমর্থন করতে।
________________________________________________
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন