Featured Post
গল্প ।। কর্মফল ।। শংকর ব্রহ্ম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
কর্মফল
শংকর ব্রহ্ম
শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন একদিন নগরে বেড়াবার সময় দেখলেন রাস্তায় একজন গরীব মানুষ ভিক্ষা করছে , তাই দেখে অর্জুনের খুব দয়া-মায়া হল। অর্জুন তাকে ডেকে, তার কাছে থাকা সোনার মোহর ভরা থলিটা তাকে দিয়ে বললেন, যাও তোমার আর ভিক্ষে করতে হবে না। এতগুলি সোনার মোহর পেয়ে, লোকটি খুব খুশি হয়ে অর্জুন কে প্রণাম করে সেখান থেকে তার জীর্ণ ঘরের দিকে রওনা হল। ঘরের দিকে যেতে যেতে সে ভাবল, এই সোনার মোহর দিয়ে আমার সব দুঃখ দুর্দশা দূর হয়ে যাবে এবার।
প্রথমে পাকা বাড়ি করব একটা , তারপর জমি কিনে চাষবাস শুরু করব, আরও কত কী করব। আমার সব রকম শখ-আহ্লাদই পূরণ হবে এইসব সোনার মোহরগুলি দিয়ে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে লোকটি যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে, ঠিক তখনই একটি চোর, যে তার পিছু নিয়ে ছিল অনেক আগে থেকেই, তার মোহরভরা থলিটা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল। লোকটি কিছুদূর পর্যন্ত তাকে তাড়া করে গেলেও তাকে আর ধরতে পারল না। তাই শেষে, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে সে নিজের ঘরে ফিরে এলো।
তারপরের দিন আবার সে ভিক্ষা করতে বেরোল। এভাবেই কাটল কিছুদিন। এর কিছুদিন পর আবার কৃষ্ণ আর অর্জুন সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে দেখেন সেই লোকটি আবারও ভিক্ষা করছে। দেখে অর্জুন খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন, ভাবলেন এতগুলো সোনার মোহর পাওয়ার পরেও লোকটি আবারও ভিক্ষা করছে কেন এখনও !
অর্জুন তাই লোকটিকে কাছে ডেকে, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি আবারও ভিক্ষা করছ কেন?
লোকটি তখন অর্জুনকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে অর্জুন নিজের গলার হীরার মালাটি খুলে লোকটিকে দিয়েদিলেন আবার।
লোকটি সেটা নিয়ে এবার খুব সাবধানে ঘরে ফিরল। ঘরে ফিরে চিন্তায় পড়ল, হীরের মালাটি এখন সে কোথায় রাখবে? ঘরে তার একটি পুরনো মাটির কলসি ছিল, যেটা কোন কাজেই লাগত না। তাই সে হীরের মালাটি সেই পুরনো মাটির কলসিতেই রেখে দিল। সারাদিন ভিক্ষা করে সে বড়ই ক্লান্ত ছিল, আর যেহেতু পরের দিন আর তার ভিক্ষা করতে যাওয়ার দরকার নেই, তাই সে রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে দেরী করে তার ঘুম ভাঙল। তার আগেই ঘুম থেকে উঠল তার বউ।
যখন সে ঘরের জন্য নদীতে জল ভরতে যাবে, তখন দেখল যেই মাটির কলসিতে রোজ জল ভরে নিয়ে আসে, তাতে একটি ছোট ফুঁটো হয়েছে। তাই সে সেই কলসিটি না নিয়ে গিয়ে, পুরনো অকেজো মাটির কলসিটি নিয়ে নদীতে জল আনতে গেল । যখন সে জল ভরার জন্য মাটির কলসিটি উল্টো করে জলে ডোবাল, তখন তার ভিতরে থাকা হীরের মালাটি নদীর জলে পড়ে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকটি যখন দেখল সেই মাটির কলসিতে জল ভরা। তখন তার বউকে জিজ্ঞাসা করে, সব কথা জানতে পেরে লোকটির মাথায় বাজ পড়ল। লোকটি তখন নিজের ভাগ্যকে আবার দোষারোপ করতে লাগল।
পরেরদিন আবারও সে ভিক্ষা করতে বেরলো। তারপর কয়েকদিন ভিক্ষা করে কাটল তার।
আবার একদিন কৃষ্ণ ও অর্জুন নগরে বেড়াবার জন্য বেরিয়ে লোকটিকে ভিক্ষা করতে দেখল।
অর্জুন লোকটিকে দেখে ভাবল, আবার কী হল তার? সেদিন হীরের মালাটি পাওয়ার পর, আজও সে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে? অর্জুন তখন সেই লোকটিকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আজও ভিক্ষা করতে বেরিয়েছো কেন?
লোকটি তখন, সেই হীরের মালাটি জলে পড়ে যাওয়ার সমস্ত বৃত্তান্ত অর্জুনকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলল। সব শুনে অর্জুন ভাবলেন, লোকটির ভাগ্য সত্যিই খারাপ, ভাগ্যে তার ভিক্ষা করা ছাড়া বোধহয় আর কিছুই লেখা নেই।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে তখন মুচকি মুচকি হাসছিলেন। অর্জুন তার মুচকি হাসি দেখে জানতে চাইলেন, লোকটির এই দুর্ভাগ্য দেখে আপনি হাসছেন কেন প্রভু?
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, লোকটির দুর্ভাগ্য দেখে আমি হাসছি না। হাসছি তোমার কথা ভেবে।
তারপর তিনি লোকটিকে একটি ছোট মুদ্রা দিলেন। ছোট সামান্য একটি মুদ্রা দেখে লোকটি মোটেও খুশি হল না, বরং হতাশ হয়ে, শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে, সেটা নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
সে যাবার পর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার দেওয়া সোনার থলি এবং হীরার মালাটি যখন তার ভাগ্য ফেরাতে পারল না তখন আপনার দেওয়া এই ছোট্ট একটি মুদ্রা আর কতটা ভাগ্য ফেরাতে পারবে তার?
শ্রীকৃষ্ণ এবারও মধুর হেসে বললেন, তাহলে চলো আমরা ওই লোকটির পিছু পিছু যাই, আর গিয়ে দেখি কী হয় শেষপর্যন্ত।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেও লোকটি ভাবল সামান্য এই ছোট একটি মুদ্রায় তো আমার পরিবারের একদিনেরও খাবার হবে না ভালভাবে।
হঠাৎ সে দেখতে পেল, একজন জেলের জালে একটি মাছ ধরা পড়েছে, তখন সে ভাবল, এই মুদ্রাটি দিয়ে বরং মাছটি প্রাণ বাঁচিয়ে তার উপকার করি। ভেবে সে সেই জেলের কাছ থেকে মাছটি কিনে, তার ভিক্ষাপাত্রে জল ভরে, তাতে করে, সেই মাছটাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো।
পরের দিন লোকটি যখন মাছটিকে নদীতে ছাড়তে যাবে ভাবছে, ঠিক তখনই দেখলেন মাছটি একটি হীরের মালা তার মুখ থেকে বের করে দিল। এটা সেই হীরার মালা, যেটা তার বৌ নদীতে জল আনতে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল। সেটা খাবার ভেবে এই মাছটি গিলে ফেলেছিল।
লোকটি তা দেখে বিস্ময়ে খুশি হয়ে, জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল, 'পেয়ে গেছি, আমি পেয়ে গেছি' বলে।
তখন সেই চোরটি সেখান থেকে যাচ্ছিল, যে লোকটির সোনার থলি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছিল। যখন সে শুনল লোকটি জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, 'পেয়ে গেছি, আমি পেয়ে গেছি', তখন সেই চোরটি ভাবল, লোকটি নিশ্চয়ই আমাকে দেখে চিনে ফেলেছে, যার জন্য সে জোরে জোরে চিৎকার করছে।
এবারে যদি লোকটি আমার নামে মহারাজের দরবারে গিয়ে নালিশ জানায়, তবে তো আর রক্ষে নেই, নিশ্চয়ই চুরি করার জন্য আমার কঠিন শাস্তি হবে মহারাজের দরবারে। শাস্তির ভয়ে চোরটি লোকটির পায়ে এসে পড়ল। আর তার কাছে ক্ষমা চাইল এবং তাকে তার সোনার মোহরের থলিটি ফেরৎ দিয়ে দিল।
লোকটি সোনার মোহরের থলিটি ফেরৎ পেয়ে চোরটিকে ক্ষমা করে দিল। তারপর সেই মাছটিকে নিয়ে নদীতে ছেড়ে দিতে গেল। নদীতে মাছটিকে ছেড়ে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে দেখল, অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ তার জীর্ণ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাদের দু'জনকে দেখে লোকটি গড় হয়ে তাদের প্রণাম করল।
অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণেকে বললেন, প্রভু যেই কাজ আমার সোনার থলি আর হীরার মালা করতে পারল না সেটা আপনার দেওয়া একটি ছোট্ট মুদ্রা কিভাবে সম্ভব করল?
তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে একগাল হেসে বললেন, সেটা লোকটির কর্মফলে সম্ভব হয়েছে।
অর্জুন জানতে চাইল, সেটা কেমন করে প্রভু,?
শ্রীকৃষ্ণে এবার বললেন, তুমি যখন লোকটিকে সোনার থলি এবং হীরের মালা দান করেছিলে, তখন লোকটি শুধু নিজের সুখের কথাই ভেবেছিল। অন্যের সুখের কথা একবারের জন্যও ভাবেনি। কিন্তু যখন আমি তাকে একটা ছোট্ট মুদ্রা দিলাম তখন সে অন্যের দুঃখ দূর করার কথা ভাবল। যার জন্য তার নিজের দুঃখও, সে নিজেই দূর করতে পারল। আমরা যখন অন্যের দুঃখের ব্যাপারে ভাবি, যখন অন্যের জন্য ভাল কিছু করার কথা চিন্তা করি, তখন আমরা নিজেরা পরোক্ষভাবে নিজেদেরও ভাল করে থাকি। স্বার্থ চিন্তা নয়, পরার্থ চিন্তাই জীবনের প্রধান ধর্ম। এটা জানলে, বুঝলে আর এটা মানলে জীবনের অনেক সমস্যা সহজেই সমাধান করে ফেলতে পারা যায়।
অর্জুন শুনে, বিস্ময়ে শ্রীকৃষ্ণের মুখে দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক।
____________________________________________________________________________________
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর লিখেছেন। আরও লিখুন।
উত্তরমুছুন