বাঙালি সত্তার বাতিঘর অন্নদাশঙ্কর রায়
সাহিত্য মানেই সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি যেখানে সর্বদা প্রতিফলিত হয় মানুষের জীবন যাপন দেশ কাল রাজনীতি। সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিভাত হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রাম। স্থান কাল চরিত্রের মাধ্যমে সাহিত্যিকের কলমে জাগ্রত হয়েছে সাধারণ মানুষের ছাপোষা জীবন। এখানেই সাহিত্যের বিশেষত্ব ও যোগ্যতা। বাংলা সাহিত্যেকে যারা চিরায়ত সৃষ্টিধারার সৃজনশীলতার সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে তন্মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায় অন্যতম। যিনি সাহিত্যচর্চাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে একটু পাল্টে দেওয়ার জন্য শোষণ মুক্ত সাম্য ও সম্প্রীতির আদর্শে মানবতার সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন প্রচন্ডভাবে দায়বদ্ধ। এখানেই তিনি অন্যান্য সাহিত্যিকদের থেকে ছিলেন অনেকটাই স্বতন্ত্র ও প্রতিবাদী সত্তার অধিকারী। অন্নদাশঙ্কর এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সাহিত্যের বিভিন্ন পথে অবাধ বিচরণ করেছেন।প্রবন্ধ, কবিতা, ছড়া। পাশাপাশি উপন্যাস, গল্প, আলোচনা। সরকারী কর্মচারী হিসাবে জীবনে সফলতার শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে ধাপে ধাপে।অন্নদাশঙ্কর রায় একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও চিন্তাবিদ। তিনি একজন বিখ্যাত ছড়াকারও। তাঁর জন্ম হয় ১৯০৪ সালের ১৫ মার্চ ব্রিটিশ-ভারতে বর্তমান ওড়িশার ঢেঙ্কানলে। তাঁর পিতা ছিলেন ঢেঙ্কানল রাজস্ট্রেটের কর্মী নিমাইচরণ রায় এবং তাঁর মাতা ছিলেন কটকের প্রসিদ্ধ পালিত বংশের কন্যা হেমনলিনী। বরাবরই তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র।
১৯২৫ সালে বিএ পরীক্ষায়ও তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯২৭ সালে এমএ (ইংরেজিতে) শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে প্রশিক্ষণের জন্য ইংল্যান্ড যান।১৯২৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনি উচ্চতর পর্যায়ের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের (আইএএস) সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ও বিচার বিভাগে কাজ করেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি আদর্শ মূল্যবোধ সততার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। যতদিন সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে তিনি ছিলেন মানব সেবায় নিবেদিত প্রাণ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অন্নদাশঙ্কর রায় ওড়িয়া সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মাত্র ২০ বছর বয়সেই। তাঁর প্রথম কবিতা রচিত হয়েছে ওড়িয়া ভাষায়। অল্প বয়সেই বের করেন 'প্রভা' নামে ওড়িয়া ভাষায় হাতে লেখা একটি পত্রিকা। বাংলা, ইংরেজি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, হিন্দি-সব ভাষায় পারদর্শী হলেও বাংলাকেই তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। বাড়ির ও কলেজের গ্রন্থাগারে তিনি সুযোগ পান ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। স্কুলে তিনি শিশু, সন্দেশ, মৌচাক, সবুজপত্র, প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকা পড়ার। মাত্র তেরো বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকার গ্রাহক হন তিনি এবং ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন নিজের লেখা।প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র' ছিল অন্নদাশঙ্করের লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণা। সর্বদা মানবতার আদর্শ দীক্ষিত অন্নদাশংকর রায় চেয়েছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয় ও সম্প্রীতির প্রশান্তি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ- সেই সঙ্গে বাংলা-ভাগ, অন্তর থেকে কখনোই তিনি মেনে নেননি। সারা জীবন অন্তরে ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছেন দেশভাগের যন্ত্রণাদায়ক ঘটনায় ।দেশভাগ-দাঙ্গা-দেশান্তর তাঁর অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, হন মর্মাহত।' আর সেই উষ্মাতেই তিনি লিখলেন- "তেলের শিশি ভাঙল বলে / খুকুর 'পরে রাগ করো / তোমরা যে সব বুড়ো খোকা / ভারত ভেঙে ভাগ করো, / তার বেলা, তার বেলা, তার বেলা?'অন্নদাশঙ্কর, তিনজন মনীষীকে─ টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী─ তাঁর জীবনে বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। একটি দু'টি প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলে, মানবজীবনের এমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই, যা বিচার করবার সময়ে তিনি তাঁদের ভাবনাবিশ্বের সহায়তা গ্রহণ করেননি। সেই সূত্রে ভাবতে-ভাবতে ওই তিনজনের জীবনের সমান্তরাল রেখা এবং বিপরীত অবস্থান সন্ধান করাও তাঁর এক অন্যতম প্রধান আবেশ হয়ে ওঠে।রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৫০ সালে পদত্যাগপত্র দেন এবং ১৯৫১ সালে তিনি বিচার বিভাগের সচিব পদ থেকে অব্যাহতি পান।দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। সাহিত্যকে ভালোবেসে ছিলেন মনে প্রানে। জীবনের চাওয়া পাওয়া প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমস্ত কিছুই ব্যক্ত করেছিলেন শাণিত কলমে। সেখানে সাহিত্য যেন হয়ে উঠেছিল জীবন দর্শন সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার প্রতিবাদের ভাষা। সাহিত্যকর্মের জন্য অন্নদাশঙ্কর রায় বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক পুরস্কারে ভূষিত করে। তাঁকে দেশিকোত্তম সম্মান প্রদান করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি.লিট) উপাধি প্রদান করে। ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় অন্তিমশ্বাস ত্যাগ করেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি। বাংলা সাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের অবস্থান চির অক্ষয়। আপামর বাঙালি সাহিত্য প্রেমীদের মননে তিনি এখনো স্মরণীয়। বাঙালি এখনো তার সাহিত্য সৃষ্টিতে খুঁজে পাই বেঁচে থাকার অবলম্বন ও শাশ্বত রসদ।১২০ তম জন্মদিনে বাঙালির জাতিসত্তার চিরায়ত প্রতিভু বাতিঘর এই ছড়াকার প্রাবন্ধিক অন্নদা শংকর রায় কে জানাই শতকোটি প্রণাম শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসা।
_____________________________________________________________________________________
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
পাভেল আমান
হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন