ঠাকুমার গল্প
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস
ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে দেশের বাড়িতে গিয়ে একমাস থাকাটা ছিল আমার কাছে সব থেকে মজার । আমাদের দেশের বাড়ি ছিল ছোট্ট একটা গ্রামে। সারাবছর কলকাতার ইঁট-কাঠ-পাথরে ঘেরা রুক্ষ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যেন ওই এক মাস প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতাম। যেন সারাবছর অপেক্ষায় থাকতাম গরমের ছুটির জন্য। অপেক্ষায় থাকতাম গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঠাকুমার মুখে ভূত পেত্নী দৈত্য দানব রূপকথার গল্প শোনার জন্য। ঠাকুমার নাতি নাতনিদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোটো। আমার ওপরের জ্যাঠতুত দাদা দিদিরা ছিল আমার থেকে বেশ খানিকটা বড়। তাই ঠাকুমার মুখে গল্প শোনার আগ্রহটা ছিল শুধু মাত্র আমারই!
আমাদের বাড়িটা ছিলো নদীর ধারে । নদীর স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনির সাথে হাওয়ার শো শো শব্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত। ঠাকুমার ঘরে নিঝুম রাতে শুয়ে শুয়ে সেই শব্দের সাথে ঠাকুমার গল্প বেশ জমে উঠতো।
তখন আমি ক্লাস ফোর। প্রতিবছরের মতো এবারও গেলাম গরমের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়িতে। খুব মজা । সামান্য কিছু হোমওয়ার্ক সেরে সারাদিন খেলে বেড়ানো। আম জাম লিচু গাছ থেকে পেড়ে খাওয়া। নদীতে ছিপ ফেলে মাছের প্রতীক্ষায় সময় গোনা ।আরো কত কী! আগেই বলেছি এই সব মজার থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল রাতে খাওয়ার পর ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনা ।
সেবার গরমটা একটু বেশিই পড়েছিল। সবাই বৃষ্টির জন্য দিনগুনছিলাম । বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এক সন্ধ্যায় দেবদূতের মতো ধেয়ে এলো কালবৈশাখী। ঝড় উঠলেই কারেন্ট অফ। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাওয়ার দাপটে দরজা-জানলার দুমদাম শব্দ। মা জেঠিমারা সবাই তাড়াতাড়ি দরজা-জানলা বন্ধ করে একটা হারিকেন জ্বালালো। ঠাকুমার ঘরে রেডিওর আওয়াজটা থেমে গেল হঠাৎ । হয়তো ব্যাটারি শেষ। চারিদিক নিস্তব্ধ । আমার খুব মজা লাগছিল সেদিন সন্ধ্যায় হোমওয়ার্কটা আর করতে হলোনা বলে। সবাই সেদিন নটা সাড়ে নটার মধ্যেই রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম। আজ আর কারেন্ট আসবে না। হারিকেনের আলোয় কতক্ষণই বা জেগে থাকা যায় ! আমি খেয়ে উঠে রোজকার অভ্যেস মতো ঠাকুমার ঘরে গেলাম গল্প শুনতে। ঠাকুমা যদিও সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই দুটো রুটি খেয়ে শুয়ে পড়ে। কখনো ঘুমায় আবার কখনো শুয়ে শুয়ে হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খায়। উপরে সিলিং ফ্যান চললেও ঠাকুমা হাতপাখা নারে। চিরকেলে অভ্যাস। তাই ছাড়তে পারেনি হয়তো। আমি টিমটিমে হাতে নিয়ে ঠাকুমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম । তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের বিশাল বাড়ির আসবেস্টাসের ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ আসছিল। সেই সাথে হওয়ার শো শো শব্দ তখনো থামেনি। ঠাকুমার ঘরে টিমটিমে নিয়ে ঢুকতেই এক দমকা হাওয়ায় টিমটিমেটা নিভে গেল । আমার কেমন গা ছমছম করে উঠলো! ভাবলাম টিমটিমেটা জ্বালিয়ে আনি। আমি ঠাকুমার ঘর থেকে যেই অন্য ঘরের দিকে যাবার জন্য পা বাড়ালাম অমনি ঠাকুমা বলে উঠলো - " কিরে বিল্টু, কোথায় যাস? কাছে আয়! গল্প শুনবি না?" আমি বললাম - " নিশ্চয়ই শুনবো । আজ ভূতের গল্প শুনবো। শুধু টিমটিমেটা একটু জ্বালিয়ে আনি মায়ের কাছ থেকে। ঘরটা যে বড্ড অন্ধকার! "
- " অন্ধকারেই তো ভূতের গল্প ভালো জমবে।" ঠাকুমা কথাটা বলেই কেমন অদ্ভুত হাসি হাসল। অন্ধকারে আমার আবার কেমন গা ছমছম করে উঠলো। আমি ভয় পেয়ে একছুটে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বসলাম । হাওয়াটা বড্ড ঠান্ডা। আমার খুব শীত করতে লাগল। বললাম- "খুব ঠান্ডা লাগছে ঠাকুমা। " ঠাকুমা বলল - " বিষ্টি পড়েছে অ্যাদ্দিন পর । তাই হাওয়া আজ ঠান্ডা।" কিন্তু আমার কেমন জানি মনে হল যে অন্য ঘরগুলোর থেকে ঠাকুমার ঘরটা যেন বেশি ঠান্ডা। তবুও আমি আর কথা বাড়ালাম না। গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম। ঠাকুমা গল্প শুরু করল।
অনেকদিন আগের কথা। ছোট্ট গ্রাম। চারিদিকে ধানক্ষেত। গাছগাছালিতে ভরা। সবুজে সবুজ। গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক ফালি নদী। সেই গ্রামেরই সবচেয়ে সেরা ডাক্তার ছিল অবনী ডাক্তার । আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও ছুটে আসত সেই অবনী ডাক্তারের কাছে। অবনী স্বভাবে চরিত্রে ছিল বড় অমায়িক।মানুষের অসময়ে সবসময় সে ছুটে যেত। সবাই বলত অবনী ডাক্তারের ওষুধ পেটে পড়লে মানুষ সুস্থ হবেই।
রাত বারোটা। অবনী ডাক্তার রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেছে। সবে চোখটা বুজে এসেছে। অমনি কড়ানাড়ার শব্দ। রাতের অতিথি মানেই বিপদের সংকেত ! আপদ বিপদ ছাড়া মাঝ রাতে ডাক্তারের বাড়িতে কেইবা কড়া নাড়বে! তাড়াতাড়ি অবনী দরজা খুলে দিল। অমাবস্যার রাত । বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মুখটা ভালো দেখতে পেল না সে।
- "কে তুমি? এত রাতে! কি হয়েছে?"
- "আমি ফকির। আপনি আমারে চিনবেন না ।পাশের গেরামে থাকি। আমার মেয়েটা বড্ড অসুস্থ। ওরে এট্টু দেখতি যাবেন ডাক্তারবাবু!
সাথে সাথে অবনী ডাক্তার একটা টর্চ হাতে নিয়ে ফকিরের সাথে যাবার জন্য প্রস্তুত হল । কিন্তু টর্চ কিছুতেই জ্বলল না ! বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হওয়ার শো শো শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই ।
- "তোমার কাছে লন্ঠন নেই ফকির?"
- "না ডাক্তারবাবু।"
- "সেকি! তুমি এত অন্ধকারে আসলে কেমন করে!" ফকির দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। কিছুক্ষন বাদে বলল - "আমার পিছন পিছন আসেন ডাক্তারবাবু। কোন ভয় নাই।" অবনী ডাক্তার ফকিরের পিছন পিছন চলল। অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ ধীরে ধীরে সয়ে যায়। অবনীরও তাই হল। ফকির যেন হাওয়ার মত দ্রুত গতিতে চলেছে। অবনী ভাবল মেয়ের অসুস্থতার কারণেই হয়তো ফকিরের এতো তাড়া। দুদিকে ধানক্ষেত। মাঝের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে দুজন। ধানক্ষেত পার হতেই নদী। অবনী ডাক্তার বলল - এত অন্ধকারে নদীর সাঁকো পার হওয়া অসম্ভব! ফকির ততক্ষণে সাঁকো পার হয়ে গেছে। যেন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে সে। অবনী সাঁকোর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করে সে সাঁকো পার হবে! এমন অন্ধকারে! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কেমন মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল তার! জ্ঞান হারালো সে! জ্ঞান ফিরলে দেখল সাঁকো পার হয়ে গেছে । মাথার কাছে বসে আছে ফকির।
- " এবারে এট্টু তাড়াতাড়ি চলেন ডাক্তারবাবু। মেইটা আমার যায় যায়! "
অবনী ধীরে ধীরে উঠে বসল। সাঁকো পর হয়ে গেছে দেখে খুব অবাক হল সে!
- " সে যাচ্ছি! তার আগে বলো আমি সাঁকো পার হলাম কী করে?"
কেমন গম্ভীর হয়ে গেল ফকির। অবনী ডাক্তারের কানের কাছে এসে কেমন অদ্ভুত ভাবে ফিসফিসিয়ে বলল - " বেশি কথা কওয়ার সময় নাই ডাক্তারবাবু! বললাম না মেইটা আমার যায় যায় অবস্থা। "
অবনী ডাক্তার চমকে উঠলো। কেমন যেন একটু গা ছম ছম করে উঠলো তার। তাড়াতাড়ি উঠে আবার হাঁটতে শুরু করল। বেশ কিছুদূর গিয়ে দেখল একটা কুড়ে ঘর । ঘরের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য।
- "হেইটে আমার ঘর ডাক্তার বাবু । আপনি আমার মেয়েটারে বাঁচান । " কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল ফকির।
ডক্তার তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে ফকিরের মেয়ের চিকিৎসা করলো । ওষুধ দিল। বলল ওষুধ গুলো খেলে সুস্থ হয়ে যাবে সে। ঘর ভর্তি লোকের মাঝে ফকিরকে আর দেখতে পেল না ডাক্তার!
- "ফকির কোথায় ?"
- "কে ফকির? ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল।"
- " আরে যে আমাকে এখানে নিয়ে এলো। এই মেয়েটির বাবা । "
গ্রামের লোক শুনে চমকে উঠলো।
- " কি বলেন ডাক্তারবাবু ! ফকির ! সে তো কবে মরি গেস। "
- "মারা গেছে! কি যা তা বলছ! ওই ই তো আমাকে নিয়ে আসলো। বলল মেয়ের খুব অসুখ।"
সবাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।
গল্পটা শুনে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম - "তার মানে ফকির আসলে ভূত! কিন্তু ঠাকুমা আমি তো জানতাম ভূতকে দেখতে একদম অন্যরকম। লাল লাল চোখ, লম্বা লম্বা দাঁত, গায়ের রং সবুজ। তাহলে ফকিরকে মানুষের মতো দেখতে হলো কি করে !" ঠাকুমা কেমন অদ্ভুত হাসি হেসে উঠলো। আমার গা ছমছম করে উঠলো! মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করলো। অন্ধকার ঘর। পাশের ঘরের হারিকেনের আলোর রেশ সামান্য ঘরে ছিল। আমি কোনো রকমে এক ছুটে মায়ের কাছে চলে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম ঠাকুমার ঘরের সামনে লোকে লোকারণ্য। সবাই কি যেন একটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে । আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম ঠাকুমাকে কেমন অন্য একটা খাটে শুইয়ে রেখেছে। ছোট ছিলাম। ওটা মৃতদেহের খাট ছিল সেটা সেদিনই প্রথম জানলাম। সবাই বলাবলি করছিলো ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ঠাকুমা দুটো রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ডাক্তার বলেছে ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। রাত আটটা নাগাদ ঠাকুমা মারা গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম! রাত আটটায় ঠাকুমা মারা গেলে আমাকে রাত সাড়ে নটার পরে গল্প বলল কেমন করে! ডাক্তার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করছে । আমি আর কাউকে বললাম না যে গতকাল রাতেও আমি ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছি । ভূতের গল্প । আমি জানতাম এ কথা বললে কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। মা বকবে। বলবে, আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি। মনটা খারাপ হয়ে গেল! ঠাকুমার কাছে আর গল্প শোনা হবে না !ঠাকুমার মত আর কেইবা এমন ভালবাসবে আমায়! সকলের ভালোবাসা আলাদা করে অন্যরকম হয় যে! দিনের শেষে রাত নেমে এল। বাড়িতে সবার মন খারাপ। আমারও । রাতের খাবার খাওয়ার পর মনটা আমার আরো ভার হয়ে গেল । এই বাড়িতে ঠাকুমার কাছে গল্প না শুনে আমি যে একটা রাতও এর আগে ঘুমাই নি ! আজ কেমন করে ঘুমাবো! আমি আস্তে আস্তে ঠাকুমার ঘরের দিকে গেলাম। ঠাকুমার একটা ফটো খাটের উল্টোদিকের চেয়ারে রাখা। গলায় ফুলের মালা। ঘরভর্তি ধুপের গন্ধ । পূর্ণিমার চাঁদের আলো ফটোর উপর পড়ে চকচক করছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হঠাৎ দেখলাম ফটোর উপরে ছায়া পড়ছে ঠাকুমা খাটে শুয়ে শুয়ে হাতপাখা নাড়ছে! রোজকার মতো! আমি ভয় পেয়ে গেলাম ! খাটের দিকে চোখ ফেরাতে সাহস পেলাম না । তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হবার জন্য যেই পা বাড়ালাম অমনি শুনতে পেলাম - "কোথায় যাস বিল্টু ! কাছে আয়! গল্প শুনবি না ? "
________________________________________________________________________________
Dollars colony, Bilekahalli, Bannerghatta Road, Bengaluru 560076
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন