Featured Post

ছড়া ।। আকাশটাকে খোঁজে ।। দীনেশ সরকার

ছবি
আকাশটাকে খোঁজে দীনেশ সরকার            পড়তে বসলে জানলা দিয়ে মন ছুটে যায় দূরে গাইছে পাখি ওই যে গাছে মিষ্টি-মধুর সুরে। কিংবা যখন হাত বাড়িয়ে আকাশ আমায় ডাকে পড়ার পাতায় মন আমার কি বাঁধা তখন থাকে?   পূবের হাওয়া কড়া নাড়ে যখন আমার দোরে কিংবা অলি গুনগুনিয়ে চতুর্দিকে ঘোরে প্রজাপতি পাখা মেলে ওড়ে ফুলের মেলায় কখন যেন অবুঝ এ মন যায় হারিয়ে হেলায়।   কাঠবেড়ালি কাটুস্‌-কুটুস্‌ আমার দিকে তাকায় মন তখন কি আটকে থাকে পড়ার বইয়ের পাতায়? টুনটুনিটা তিড়িং-বিড়িং পুচ্ছ নাচায় গাছে মনটা বাঁধা তখন কি আর অঙ্কখাতায় আছে?   অঙ্ক কষতে ভুল হয়ে যায়, পড়া যাই যে ভুলে স্যারের বকা মাঝে মাঝেই খাই আমি ইস্কুলে। মনকে আমি কত্ত বোঝাই, মন তবু কি বোঝে সুযোগ পেলেই জানলা দিয়ে আকাশটাকে খোঁজে।   ******************************************** দীনেশ সরকার ১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি, প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর---- ৭২১৩০৬

নিবন্ধ ।। ভাষাচর্চায় রামমোহন রায় ।। অরবিন্দ পুরকাইত



Raja Ram Mohan Roy | Letters to the editor: Raja Ram Mohan Roy, Fragmented  light - Anandabazar


ভাষাচর্চায় রামমোহন রায়
অরবিন্দ পুরকাইত 
 
আজকের দিনে খুব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনেককেই কলকলিয়ে ইংরেজি বলতে শুনলে আমরা আর আশ্চর্যবোধ করি না। বিশেষত প্রচুর ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের সুবাদে এ এখন আকছার ঘটনা যেন! বাঙালিরা বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়েই ইংরেজি শিখেছে দীর্ঘদিন। একসময় খুব কম লোকই ইংরেজি শিখত। রাজা রামমোহন রায়ের সময়ে ক'জনই বা আর শিখত ইংরেজি! স্বয়ং রামমোহনই তাঁর ইংরেজি শিক্ষা শুরু করেছিলেন অনেক পরে। আমরা এখানে সেই প্রসঙ্গ এবং তার সঙ্গে রামমোহনের একাধিক ভাষাচর্চা ও অন্যান্য কিছু প্রসঙ্গ একটু ফিরে দেখব।
       যেকোন ভাষাভাষী মানুষের কাছে তাদের মাতৃভাষা পরম আদরের। মাতৃভাষা আসলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সাধারণত বংশপরম্পরার ভাষা। জন্মের পরমুহূর্ত থেকেই মায়ের কাছ থেকে সেই ভাষা শোনে শিশু। আস্তে আস্তে তার মধ্যে সেই ভাষার বোধ তৈরি হয়। মায়ের আদরের ভাষা, শাসনের ভাষা, দরকারের ভাষা, গান-গল্পের ভাষা সবকিছুই শিশু আস্তে আস্তে বুঝতে শেখে। তার পরিবারে, তার পাড়ায় ভিত তৈরি হয়ে যায় তার আপন ভাষার। যে-যার নিজস্ব ভাষা মানুষ সহজে ভুলতে পারে না। সে ভাষা তার কাছে সারা জীবনের সম্পদ, আবেগ। কেন-না সে ভাষার শব্দ, বাক্য — বলার ধরনে যে অনুভূতি ব্যক্ত হয়, যে ছবি ফুটে ওঠে ছোটবেলা থেকে তা আর সহজে ভোলা যায় না। জড়িয়ে থাকে মানুষের স্মৃতিতে সারাটি জীবন। তাই মাতৃভাষা বা যে-যার জাতি বা গোষ্ঠীর ভাষা মানুষের কাছে পরমপ্রিয়। মানুষ যত ভাষাই শিখে থাকুক না কেন, মাতৃভাষা তাই তাদের কাছে বিশেষ ভাবেই অর্থবহ, অনেক বেশি বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন। নিজের ভাষা সবসময়ই গৌরবের কেন-না তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক কাহিনি-গল্পগাথা, ইতিহাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি। কোনও দেশ বা জাতির মাতৃভাষায় যেন থাকে সেই দেশের মূল ও শিকড়! মাতৃভাষা তাই থেকে যায় তাদের কাছে পরম সম্পদের মতো। অন্য ভাষা শিখে দরকারি কাজকর্ম করা থেকে সে ভাষায় রচিত সাহিত্য, সে ভাষার শিল্প-সংস্কৃতির নিকট হয়ে ওঠে মানুষ, আরও সমৃদ্ধ হয়। কেন-না সেইসব ভাষার মধ্যে দিয়ে সেই ভাষায় কথা-বলা মানুষদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে মানুষ। তাতে করে এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে, ভালবাসতে শেখে অন্যান্য ভাষাকেও। সব ভাষায় যে অনেক সম্পদ রয়েছে সেটা বুঝতে শেখে মানুষ, তাই ভাষা নিয়ে অযথা গোঁড়ামি কেটে যায়। সব ভাষা মর্যাদার আসন পায় একাধিক ভাষা-জানা মানুষের কাছে। 
        ভিন্ন ভিন্ন ভাষাশিক্ষায় হয় কী, অন্য ভাষার প্রতি অন্য সংস্কৃতির প্রতি অন্য রাজ্য বা দেশের মানুষদের প্রতি মন উদার হয়, চেনা ভাবনার বাইরেও অনেককিছু জানা যায় এবং বুঝেসুঝে সেসব গ্রহণ করার মানসিকতাও তৈরি হয়। আবার নিজেদের মাতৃভাষার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভাষাতেও শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখার দৃষ্টান্তও নিতান্ত কম নয় সারা পৃথিবীতে।
       রাজা রামমোহন রায় যে বিচারশীল মানুষ ছিলেন — যুক্তি দিয়ে, বিচারবোধ দিয়ে সবকিছু গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন, তার পিছনে তাঁর একাধিক ভাষাশিক্ষার অবদান কম নয়। বাংলা ছাড়া আরও নয়টি ভাষা জানতেন তিনি! আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, উর্দু, ইংরেজি, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন ও ফরাসি। বইপত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লেখাজোখাও করেছেন একাধিক ভাষায়। বিভিন্ন ভাষায় বইপত্র পড়ার ফলে সেইসব ভাষাভাষীর মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের রুচি, পছন্দ, আচার-আচরণ সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়ার ফলে মনের সংকীর্ণতা কেটে যায়, অনেক বিষয়ই উদারভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়। রামমোহন রায় জ্ঞানের রাজা ছিলেন। এইখানে মনে করে নিতে পারি আমরা যে 'রাজা' হল রামমোহন রায়ের উপাধি। দ্বিতীয় আকবর শাহ তাঁর বৃত্তি ইত্যাদি বাড়াবার নিমিত্ত ইংল্যান্ডে দরবার করবার জন্যে বিদ্যা-বুদ্ধি, বলিষ্ঠ দৈহিক গড়ন, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি মিলিয়ে একমাত্র রামমোহন রায়কে উপযুক্ত বিবেচনা করেছিলেন। তিনিই রাজা উপাধি দিয়েছিলেন তাঁকে। এদিকে রামমোহনেরও ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। তাঁর আগে দু-একজন বাঙালি বিদেশ পাড়ি দিলেও, একাধারে দেশ-বিদেশের জ্ঞান ও বিদেশ পাড়ি দেওয়া, বিদেশেও তাঁর অনেক গুণগ্রাহী-বন্ধুবান্ধব — সব মিলিয়ে রামমোহনকে বলা হয় প্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি।
       রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের দুশো পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার বছর এটি,  ১৭৭২ তাঁর জন্মসাল ধরে। রামমোহনের পিতা-পিতামহরা নবাব-বাদশাদের অধীন চাকরিতে হাত পাকিয়েছেন। তাঁর প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ঔরঙ্গজেবের আমলে নবাব সরকারে কাজ করতেন, মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে তিনি রায়-রায়ান উপাধি পেয়েছেন (কেউ কেউ বলেছেন রায় রায়)। এঁর আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদের সাঁকাসা গ্রামে, পরে হুগলি জেলার খানাকুল কৃষ্ণনগরের কাছে রাধানগর গ্রামে চলে আসেন। এখানেই রামকান্ত রায় ও তারিণী দেবীর সন্তান রামমোহনের জন্ম ১৭৭২ সালে। কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে রায় তাঁরা। জন্মের আড়াইশো বছর হওয়ায় এ বছরটা তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হচ্ছে। চলেছে তাঁকে নিয়ে লেখাজোখা, আলোচনা সভা ইত্যাদি। আসলে তাঁর মতো মানুষকে নিয়ে কেবল দুশো পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ার জন্যেই নয়, বরাবরই আলোচনা হওয়া দরকার। তাঁকে বলা হয় আমাদের দেশের নতুন করে জেগে ওঠার অর্থাৎ নবজাগরণের পথপ্রদর্শক। তখন আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার, আচার-বিচারের বাড়াবাড়ি, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ইত্যাদি ছিল যা মানুষের উন্নতির পথে অনেকসময় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত। কোনও নারীর সন্তান না হলে, সন্তানকামনায় প্রথম সন্তানকে গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দেওয়ার মানসিক করা এবং সেইমতো সন্তান বিসর্জন দেওয়া, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে তার চিতায় জীবন্ত পোড়ানো — যাকে সতীদাহ প্রথা বলা হত, এইরকম সব। তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝে, বিচার-বিবেচনা করে তবেই সবকিছু গ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে করতেন। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর দু-একটি বইয়ের নাম দেখলে তা বোঝা যাবে। যেমন, 'ভট্টাচার্যের সহিত বিচার', 'গোস্বামীর সহিত বিচার'। তাঁর মত ছিল, তর্ক-বিতর্ক হওয়া উচিৎ শান্তভাবে, কাউকে আঘাত করে নয়। সত্যর অনুসন্ধানে পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গর  নয়।
        তখনকার নিয়ম অনুযায়ী তিনি খুব অল্প বয়সে বাড়িতে গুরুমশাইয়ের কাছে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন শুভঙ্করী পাঠের মধ্যে দিয়ে। শৈশবে তিনি পাঠশালা ও টোলে পড়েছেন। মক্তবে পড়েছেন ফার্সি ও আরবি। ফার্সি তখন অনেকেই শিখত, কেন-না তখন তা ছিল দেশ-শাসন তথা সরকারি কাজকর্মের ভাষা। ন'বছর বয়সে আরবি ও ফার্সি ভাষা শেখার জন্যে তাঁকে পাটনা পাঠানো হয়। পাটনা তখন আরবি ও ফার্সি শেখার প্রধান ক্ষেত্র। সেখানে তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখে পড়েন কোরআন ও মুসলমাননদের ধর্মশাস্ত্র, পড়েছিলেন সুফি সাধকদের রচনা। সুফি সাধকদের রচনা তাঁকে খুব টানত। বারো বছর বয়সে পাটনা থেকে ফিরলে ব্যবস্থা হল তাঁর সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার, যা ছিল সেই সময় জ্ঞানচর্চার প্রধান বাহন। বলা হয়ে থাকে যে সংস্কৃত শেখার জন্যে তাঁকে কাশীতে পাঠানো হয়েছিল, যা ছিল সংস্কৃতশিক্ষা ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পাঠের পীঠস্থান। তিনি বাইবেল পড়েছিলেন। মূলে বাইবেল পড়ার জন্য তিনি হিব্রু এবং ল্যাটিন ভাষা শিখেছিলেন। এসবই তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। বিভিন্ন ভাষায় ধর্মশাস্ত্র, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি পাঠের ফলে তিনি মূর্তিপূজায় আর আস্থা রাখতে পারেন না। এক ও অদ্বিতীয় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেন তিনি। পরে তিনি আত্মীয়সভা বলে এক সভা শুরু করেন যা পরে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। পরে ব্রাহ্মমন্দির স্থাপিত হয়, যেখানে কোনো দেবদেবীর মূর্তি বা ছবি থাকে না। একজন আচার্য থাকেন। ব্রাহ্মমন্দিরে প্রার্থনা হয়, ধর্ম আলোচনা হয়, ব্রহ্ম সম্বন্ধীয় গান বা ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়। যে-কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ সে সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। রামমোহন নিজে সুন্দর সুন্দর ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন। যেমন, 'ভাব সেই একে/জলে স্থলে শূন্যে যে সমানভাবে থাকে।/যে রচিল এ সংসার/আদি অন্ত নাহি যার/সে জানে সকল, কেহ নাহি জানে তাকে।'
       আজকের দিনে ব্যাপারটা তত কঠিন নয় হয়তো, কেন-না ভাষাশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বইপত্র পাওয়ার সুবিধা, বেতার-দূরদর্শন প্রভৃতিতে বিভিন্ন ভাষায় সংবাদ, অনুষ্ঠান ইত্যাদি শোনা বা দেখা অনেক সহজ করে দিয়েছে কাজটাকে। সবচেয়ে সহজ করে দিয়েছে এখন চলভাষ যন্ত্রটি অর্থাৎ মোবাইল ফোন। নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে দিনরাতের যে-কোনো সময়ে সেখানে ধারাবাহিকভাবে তার সাহায্যে শেখা যায় পৃথিবীর নানান ভাষা। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার অত্যন্ত অসুবিধার সেই দিনে একাধিক ভাষাশিক্ষা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। বিশেষত গ্রামের দিকে। মোবাইল দূরের কথা, কতটুকু আর সুবিধা ছিল ভাষাশিক্ষার স্কুল পাওয়া, বইপত্র, শিক্ষক ইত্যাদি পাওয়া! সুবিধা পাওয়া যায় কেবল সেই ভাষাশিক্ষার, যে ভাষায় দেশের কাজকর্ম চলে অর্থাৎ দেশ যারা শাসন করে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ভাষা বা সরকারি ভাষা। আমাদের দেশে একসময় যা ছিল ফার্সি এবং ইংরেজদের আগমনের পর ১৮৩৮ সাল থেকে যা হল ইংরেজি। তখনকার দিনে অন্য ভাষা শিখতে হলে মূলত নিজেদেরই সেসব খোঁজখবর করে ব্যবস্থা করে নিতে হত — শিক্ষক, বইপত্র বা বিরল দু-একটি বিদ্যালয়। অন্য দেশ থেকে অনেকসময় বই আনানোর ব্যবস্থা করতে হত। তাও সেকালে অর্থাৎ সেই দুশো বছরের আগে-পরে একাধিক ভাষাশিক্ষা করেছেন রামমোহনের পরে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তরা।
       রামমোহন রায় কুসংস্কারমুক্তির অন্যতম হাতিয়ার করেছিলেন তাঁর লেখাজোখা, পত্রিকার সম্পাদনা ইত্যাদিকে। তিনি সংস্কৃত ভাষা থেকে যেমন বাংলায় অনুবাদ করেছেন আমাদের উপনিষদ ইত্যাদি, তেমনই বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ভাষাতেও লেখাজোখা করেছেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ভূগোল বই লিখেছেন। লিখেছেন 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ'। 'তুহ্ফত্-উল-মুওয়াহিদ্দিন্' নামে তিনি ফার্সি ভাষায় একটি বই লেখেন, যার মানে, 'একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার'। এই বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি আরবি ভাষায়। এইখানে একটু বলি যে এই বইটিতে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও যুক্তিশীলতা প্রকাশ পেয়েছে। শেষে তিনি বলছেন, 'বিশ্বমানবকে শান্তি দাও।' (অনুবাদে) বাংলা ভাষায় তিনি 'সংবাদ কৌমুদী' ও ফার্সি ভাষায় 'মিরাৎ-উল্-আখ্্বার' নামে দুটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। 'ব্রাহ্মণ সেবধি/BRAHMUNICAL MAGAZINE' নামে দ্বিভাষিক — একই পত্রিকায় বাংলা ও ইংরেজি — একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। নিজেই নিজের লেখার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন দেশের অন্যত্র প্রচারের জন্যে। ‌ফ্রান্সে যাওয়ার আগে তিনি চলার মতো শিখে নিয়েছিলেন ফরাসি ভাষা। তাঁর ইংরেজিশিক্ষা কিন্তু অনেক বড়বেলায়। বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ইংরেজির প্রায় কিছুই জানতেন না। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সেও তাঁর ইংরেজি লেখার হাতই তৈরি হয়নি। আজকের দিনে অনেকের ক্ষেত্রে যেটা হয়তো ভাবাই যায় না। পরে তিনি ইংরেজিতে অত্যন্ত সাবলীল হয়ে ওঠেন এবং ইংরেজি ভাষায় লেখাজোখাও করেন। রামমোহন রায়ের একটি জীবনী লিখেছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর মনে হয়েছে যে হুগলি জেলার রাধানগরের সুখসাগরের কাছে পালপাড়া গ্রামনিবাসী নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের কাছেই রামমোহনের সংস্কৃতশিক্ষা। এই নন্দকুমার প্রথম জীবনে ছিলেন অধ্যাপক এবং পরবর্তী জীবনে তান্ত্রিক সাধনা করে হয়েছিলেন হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামী কুলাবধূত। এখনকার বাংলাদেশের রংপুরে কাজ করতেন রামমোহন ডিগবি সাহেবের অধীনে, যিনি রামমোহনের বিদ্যা-বুদ্ধি ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় পেয়ে তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এই ডিগবি সাহেবের সাহচর্যেও ইংরেজি শিক্ষা রামমোহনের, রংপুরে থাকাকালীন। আর রামমোহন তাঁকে শেখাতেন সংস্কৃত। বাইশ বছর বয়সে রামমোহন শুরু করেছিলেন ইংরেজি শেখা, কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হওয়া হয়ে ওঠে না। পরে ওইভাবে শুরু করে, আপন অধ্যবসায়ে সেই ইংরেজি ভাষায় একসময় তাঁর দক্ষতা হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকলে অনেক কিছুই যে সম্ভব হয়ে ওঠে, এ তার এক দৃষ্টান্ত। তাঁর এই যে এতগুলো ভাষাশিক্ষা, বিশ্বের নানান ভাষার ধর্মশাস্ত্র থেকে বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি পাঠের মাধ্যমে অগাধ জ্ঞান অর্জন করা, এ সম্ভব হয়েছিল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অসম্ভব জেদের ফলে। 
        কেমন সে জেদ? একটি মাত্র উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। তিনি রামায়ণ পড়েছিলেন মাত্র একদিনে, ভাবা যায়! তিনি সকালবেলা স্নান সেরে বাড়ির লোকেদের বলেছিলেন যে তাঁকে যেন ডাকা না হয়। তিনি দরজা বন্ধ করে সকালবেলা বাল্মীকির রামায়ণ পড়তে শুরু করলেন। বিকেল হয়ে যাচ্ছে, তখনও দরজা খোলার নাম নেই! বাড়ির লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। তখনও খাওয়া হয়নি তাঁর। তো এক মহিলা দরজাটা সামান্য ফাঁক করলেন, পাঠরত রামমোহন বুঝতে পেরে ইশারায় জানালেন যে আর সামান্যই বাকি আছে। তিনি বাকিটুকু পাঠ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভাবা যায়, এক বসাতেই মূল সংস্কৃতে পুরো রামায়ণ পড়ে ফেলা! তো এই পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও জেদ তাঁর এতগুলো ভাষা শেখার সহায়ক হয়েছিল নিশ্চয়ই।
       রামমোহনের আত্মমর্যাদাজ্ঞান ছিল প্রখর। নারীর প্রতি সম্মান ছিল বরাবর, নারীর 'উৎকৃষ্ট মানবীয় গুনাবলী'র সুযোগে পুরুষরা অনেকসময় তাদের বঞ্চিত করে বলে বলেছেন তিনি দ্বিধাহীনভাবে। লর্ড বেন্টিঙ্ককে দিয়ে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করিয়েছিলেন। শাস্ত্র থেকেই দেখিয়েছিলেন যে স্বামীর মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না নারীকে। বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন তিনি, মানতে পারেননি কন্যাপণও (বিয়ের সময় কন্যার পরিবারকে পাত্রপক্ষের অর্থ ইত্যাদি দেওয়া)। দেশ-বিদেশের জ্ঞান আহরণের জন্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অর্থাৎ পুবের দেশ ও পশ্চিমের দেশের শিক্ষার মিলন চেয়েছিলেন। পৌত্তলিকতা বা পুতুলপুজো মানতে পারেননি, তার বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেছিলেন।
       এইসব করতে গিয়ে তিনি পুরোনো পথ আঁকড়ে-থাকা লোকেদের, সমাজপতিদের কোপে পড়েছিলেন। তারা অনেক বিষয়েই তাঁর বিরোধিতা করেছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে, তাঁর নামে নিন্দামূলক ছড়া লিখে প্রচার করে বেড়িয়েছে। নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গেও মতভেদ হয়েছে, গৃহত্যাগও করতে হয়েছে। পরে রামমোহন ফিরে এলে আনন্দ পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু মতের মিল হয়নি কখনো পুরোপুরি। অসম্ভব মনের জোরে বরাবর তিনি আপন পথে চলেছেন। আজ এত বছর পরেও তাঁর অনেক লেখা পড়লে এক আধুনিক মানুষের সাক্ষাৎ লাভ করি আমরা। শ্রদ্ধাবনত হই।
_____________________________________________________________________________________
 
লেখাটি লিখতে আমি যেসব বইয়ের সাহায্য নিয়েছি তার কয়েকটি:

রামমোহন রচনাবলী — প্রধান সম্পাদক অজিতকুমার ঘোষ; সম্পাদকমণ্ডলী মণি বাগচি, শিবদাস চক্রবর্তী ও আবদুল আজীজ আল্‌ আমান। হরফ প্রকাশনী
রামমোহন রায় — ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা – ১৬, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, পঞ্চম সংস্করণ – জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭ 
রাজা রামমোহন রায় – অমৃতলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বাস পাবলিশিং হাউস, তৃতীয় প্রকাশ – আশ্বিন ১৩৮২
রামমোহন রায়ের জীবনী – শশিভূষণ বসু, দ্বিতীয় সংস্করণ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কার্য্যনির্ব্বাহক সভা কর্ত্তৃক প্রকাশিত, ১৩৩২।

[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
 

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

কবিতা ।। আকাশ-সাগর ।। শান্তনু আচার্য

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

কবিতা ।। নতুন বছর ।। জীবন সরখেল

চোখের ভাষা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত

ছড়া ।। শীতের দু'টি মাসে ।। গোবিন্দ মোদক

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 24th issue: September 2023

ছোটদের আঁকিবুঁকি ।। কিশলয় - ২২ ।। জুলাই ২০২৩

ছড়া ।। দৃষ্টিকাড়া বৃষ্টি ।। শচীন্দ্র নাথ গাইন

ছড়া ।। অদ্ভূতুড়ে ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

কবিতা ।। আকাশ-সাগর ।। শান্তনু আচার্য

ছড়া ।। শৈশবের রথ ।। ইয়াসমিন বানু

কবিতা ।। নতুন বছর ।। জীবন সরখেল

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

অণুগল্প ।। ঝুমুক ঝুমুক ।। ব্রজ গোপাল চ্যাটার্জি

ছোটগল্প ।। হেমন্ত দাদার সাথে ।। দীপক পাল

ছড়া ।। আকাশটাকে খোঁজে ।। দীনেশ সরকার

ছড়া ।। শীতবুড়িটা ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

কবিতা ।। খুকির বায়না ।। খগেশ্বর দেব দাস

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। চতুর্ত্রিংশ সংখ্যা ।। জুলাই ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। পঞ্চত্রিংশ সংখ্যা ।। আগষ্ট ২০২৪

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২