Featured Post
গল্প।। আগুন পাহাড়ের দ্বীপে ।। ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ঢোলগোবিন্দের কড়চা
আগুন পাহাড়ের দ্বীপে
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসের উড়ুক্কু গাড়ি প্রথম অভিযান সফল হয়েছিল ঢোলের মামার বাড়ি। ঢোলগোবিন্দ তো বটেই প্রফেসর নিজে পর্যন্ত খুব সন্তুষ্ট এই আকাশ পরিক্রমায়। এই উড়ন্ত পাদুকার নাম প্রফেসর রেখেছিলেন এন্টি গ্রাভিটি সু। এখন তো এর অনেক উন্নতি হয়েছে। আর তাই নাম রেখেছেন ফ্লাইং ট্রে। তাঁর এই পরীক্ষা যদি সফল হয় তো তিনি এর পেটেন্ট নেবেন আর এর উন্নতি ঘটাবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।
ঢোল আর গোবিন্দ একদিন বিনা ডাকেই প্রফেসরের কাছে এসে হাজির।
-কি ব্যাপার আমি তো তোমাদের ডাকি নি?
এই সেরেছে প্রফেসর চট করে ক্ষেপে যান বলেই তো তাঁর নাম ক্ষেপচুরিয়াস। দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেল। গত কাল ঢোলের মামা আবার তাঁর জন্যে আইসক্রিম এনেছিল। প্রফেসরের দিকে সেটা এগিয়ে দিতেই স্যারের মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল। সামান্য হেসে বললেন, আরে এই ব্যাপার? বেশ বেশ।
ঢোল বলল, স্যার আপনার ওই ফ্লাইং সুতে আমাদের আর একদিন চাপাবেন?
ক্ষেপচুরিয়াস একটু ক্ষেপে গেলেন, ফ্লাইং সু নয় ঢোল, এন্টি গ্র্যাভিটি ট্রে বা ফ্লাইং ট্রে। ঠিক নামটা বলতে শেখ। মনে রাখবে তোমরা কিন্তু আমার মানে বিখ্যাত মহাকাশবিদ প্রফেসর ক্ষেত্রবিনোদ আচার্যের সহকারী।
গোবিন্দ বলল, স্যার আমরা কি আর-
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস মৃদু মৃদু মাথা নাড়তে লাগলেন আর হাসতে লাগলেন নীরবে। একটু আশ্বাস পেল যেন দুজনে।
-আমরা খুব তাড়াতাড়ি একটা প্রজেক্টে হাত দিতে চলেছি ঢোলগোবিন্দ।
সাগ্রহে দুজনে সমস্বরে বলে উঠল, কি প্রজেক্ট স্যার?
সেটা টের পেল কয়েক দিন পরে। দুজনেই তাদের মোবাইলে মেসেজ পেলঃ উই আর ট্রাইং টু ফ্লোট অন সি।
মানে সাগরের ওপর দিয়ে উড়বে। দুজনের আনন্দ তো আর ধরে না। ঢোল একটু আশংকা প্রকাশ করল, হ্যাঁরে গোবিন্দ আমরা পড়ে যাব না তো সাগরে?
আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।
প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস আশ্বাস দিলেন, ভয় নেই কেউ পড়বে না। এতে প্যারাসুটের ব্যবস্থাও আছে। পড়ে গেলে তোমরা উড়ে যাবে।
মানে উড়তে উড়তে পড়বে।
প্রফেসর এবার আর ঠিক সু বানান নি। বানিয়েছেন একটা ট্রের মত কিছু। তবে তার ওপর একটা ধরে দাঁড়ানোর রডও দিয়েছেন। সাগরের ওপর দিয়ে যেতে হবে তাই এই সতর্কতা। কিন্তু কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
ঢোল জিজ্ঞেস করল, কোন সাগরের ওপর দিয়ে আমরা যাব স্যার?
গোবিন্দ বলল, মনে হয় ভূমধ্যসাগাগর।
-ধ্যাত সে অনেক দূর।
-কিন্তু তাতে অনেক সুবিধে রে।
ঢোল বলল, ভূমধ্য মানে তো তার চারিদিকে দেশ আছে। তাই পড়ে গেলেও সাঁতরে যে কোনও একটা পাড়ে উঠে পড়া যাবে।
প্রফেসরের মোটা গোঁফে একটা লুকোন হাসি টের পেল দুজনে। প্রফেসর তাদের মোটামুটি একটা ট্রেনিং দিলেন। যদিও প্রত্যেকের নিজ নিজ একটা করে উড়ন জুতোর ব্যবস্থা করা আছে কারণ আলাদা করে কোথাও কখনও যদি যেতে হয়। কিন্তু বাকি সময় একসঙ্গে এই ট্রের মধ্যে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। মধ্যিখানে প্রফেসর নিজে আর তার দুইপাশে দুজন। প্রফেসর চালক আর গাইড। এরা দুজন সহকারী।
আপাতত ঠিক হয়েছে এক সপ্তাহের ভ্রমণ হবে। মোটামুটি আকাশের অবস্থা ভাল যখন তখন বেরোন হবে। সাতদিনের কিছু খাবার দাবার নিয়ে যাওয়া হবে আর পথে কোনও লোকালয় পড়লে সেখান থেকে কিনে নেওয়া হবে। বাড়িতে সবাই যেন জানিয়ে আর বাড়ির থেকে ঠিকঠাক অনুমতি নিয়ে রাখে।
নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু হল। পাছে শোরগোল হয় তাই একেবারে ভোরে যাত্রা শুরু হল। প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াসের সেই আকাশযান ভারি সুন্দর দেখতে। কতকটা রাজগীরের রোপওয়ের মত। তবে এর কোনও ছাদ নেই। আর সেই ছাদ কোনও তার আর কপিকলের সঙ্গে জোড়াও নেই। একটা প্ল্যাটফর্ম যাতে তিনচারজন দাঁড়াতে পাশাপাশি। মাঝখান থেকে একটা মোটা রড উঠে গিয়ে তার ওপর একটা মোটা রড পেতে দেওয়া হয়েছে হাত দিয়ে ধরে দাঁড়াবার জন্যে। সেই রডের কতগুলি বোতাম। বাকি সব কিছু সেই তাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ ভ্রমণ পর্বের মত ভার্চুয়াল। বৃষ্টি এলে মাথায় একটা ছাতা তৈরি হয়ে যাবে। তবে তার নির্দেশও দেওয়া আছে কিন্তু সেই ভার্চুয়াল স্ক্রিনে।
এবারেও এই যাত্রার সাক্ষী রইল মরা ইঁদুরের ভাগ নেওয়ার অপেক্ষায় ইলেকট্রিকের তারে অপেক্ষা করা কতগুলো কাক, ডাস্টবিনে খাবারের জন্যে ঝগড়া করা কতগুলো কুকুর আর মিনিমাসির রান্নাঘরে ঢুকে মাছ চুরি করা সেই মিনি বেড়ালটা। আপাতত এর বেশি সাক্ষী না রাখাই ভাল। এরা বাগড়া দিলে বিপদ।
রডের একেবারে মাঝের লাল বোতাম টিপে ইগ্নিশন স্টার্ট করলেন প্রফেসর। এটাও চলে সোলার ব্যাটারিতে মানে সৌরশক্তিতে। এন্টি গ্র্যাভিটি বাটন টিপে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকলেন। মুখে বললেন, স্টপ। সেইখানে দাঁড়িয়ে রইল আকাশযান। জি অই এস অন করা হল। গুগুল ম্যাপ খুলে গেল সামনে। এবার আর গন্তব্য কিছু বলা হল না। প্রফেসর বললেন, গো।
যান চলতে শুরু করল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ঝাপটা মারতে শুরু করল। বেশ ভাল লাগছিল তাদের। নেভিগেশনকে স্টিয়ারিং হিসেবে ব্যবহার করে স্পীড কনট্রোল করতে লাগলেন প্রফেসর। নিচে নানা বাড়ি ঘর দোর গাছপালা রাস্তা কত কি। কিন্তু সেই আকাশগাড়িটা যে বেশ দ্রুত এগোচ্ছিল সেটা তাদের দিব্বি মালুম হচ্ছিল। ঢোলের মামার বাড়ি বলরামপুর যেতে যতটা উঁচুতে উঠতে হয়েছিল এখন উঠতে হয়েছে তার চেয়ে অনেক দূরে। ফলে নিচের ঘরবাড়ি সব ছোট হতে হতে এখন মিলিয়ে গেছে। ঢোলগোবিন্দ কখনও প্লেনে চড়ে নি। তাই এই অভিজ্ঞতাও তাদের হয় নি।
জিপিএস দেখে প্রফেসর বললেন, আমরা এখন সুন্দরবনের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি।
-কোথায় কোথায় বাঘ কোথায় স্যার? ঢোল চেঁচিয়ে বলে উঠল।
গোবিন্দ বলল, এত ওপর থেকে বাঘ দেখবি? দেখছিস না সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া।
এরপর একটা মজার ব্যাপার হল। তারা ঢুকে গেল একরাশ পেঁজা তুলোর মধ্যে। ঢোলগোবিন্দ তো ভেবেই পেল না তুলোর মধ্যে দিয়ে মানুষ যায় কি করে। কিন্তু চারিদিকে শুধু পেঁজা তুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। প্রফেসর শুধু বললেন, আমরা একটা মেঘমন্ডলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। তাই মেঘ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
একটু পরেই সেই মেঘ সরে গেল আর বেরিয়ে পড়ল শুধু নীল জলরাশি।
-সাগর! বলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ঢোল।
-বঙ্গোপসাগর। বলে উঠলেন প্রফেসর।
গোবিন্দ বলল, কি দারুন স্যার। কি ঢেউ!
প্রফেসর তাদের জল দেখানোর জন্যে নামিয়ে এনেছিলেন যানটাকে।
এখন আবার ওপরে উঠতে শুরু করলেন। আবার নিচেটা ধোঁয়া ধোঁয়া। ঢোল জিজ্ঞেস করল, স্যার আমরা যাচ্ছি কোথায়?
হাতঘড়ি দেখে বললেন প্রফেসর, দু’ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়েছে। আমরা এখন আন্দামানের মাথার ওপর আছি। আশার কথা আমরা প্লেনের থেকে সামান্য পিছিয়ে আছি। কোলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে প্লেন সময় নেয় দুঘন্টা চার মিনিট। তাই আমরা মাত্র একচল্লিশ মিনিট পিছিয়ে আছি বেশি নয়।
কিন্তু দিন তো সর্বদা একরকম যায় না। একটা ছোট্ট ঘূর্ণিঝড় উঠে যেতেই বিপত্তি। একটা গাছের পাতার মত পাক খেতে আকাশ যান নিচে নামতে লাগল। নিচে কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ তিনজন ছিটকে পড়ল যান থেকে। ভাগিস তাদের পিঠের সঙ্গে একটা করে প্যারাসুট বাঁধা ছিল। যান পড়তে পড়তে সোজা ঘাঁত করে ডুবে গেল সাগরের জলে। প্রফেসর কেঁদে উঠলেন। এত দিন ধরে এত যত্নে গড়ে তোলা তাঁর সাধের ফসল কিনা এখন সাগরের প্রবাল পাহাড়ে গিয়ে আটকে থাকবে?
কিছুদূর উড়তে উড়তে বাকি দুজনকে কিন্তু দেখতে পেল না ঢোল। কিন্তু সে তো উড়ছে প্যারাসুটে। এটা তো আর প্রফেসেরের তৈরি আকাশযান নয় তাই তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ঝড়ে যেমন করে তুলো উড়ে যায় তেমন করে নিজের মনে উড়ে উড়ে চলেছে। উড়তে উড়তে প্যারাসুট গিয়ে পড়ল একটা জঙ্গলে। যদিও বড় বড় ঘাস ছিল। তাই তেমন লাগল না ঢোলের। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। এটা একটা দ্বীপ বলে মনে হল। এ পর্যন্ত সে কোনও দ্বীপে কখনও আসে নি। তবে দ্বীপের ছবি অনেক জায়গায় দেখেছে। তাতে মনে হল এটা একটা দ্বীপ। তারা প্রফেসরের আকাশযানে করে তো সমুদ্রের ওপর দিয়েই আসছিল। প্রফেসর বলছিলেন তারা নাকি আন্দামানের দিকে যাচ্ছেন। গোবিন্দ নেই। নেই প্রফেসরও।
কে জানে এরা কোথায় গেল। আর এদের না পেলে এখান থেকে বাড়িতে ফিরবে কি করে? সে স্পষ্ট দেখেছে তাদের দুজনকে প্যারাসুট খোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সে ততক্ষণে উড়তে শুরু করে দিয়েছে আর বেশি খেয়াল রাখতে পারে নি।
এমন অবস্থা যে হবে বা হতে পারে বিন্দুমাত্র আন্দাজ আগে থেকে পায় নি ঢোল। বরং সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার আনন্দে মশগুল ছিল। কিন্তু এবার তার কান্না এসে গেল। একেবারে অজানা জায়গা, শুধু জল, জঙ্গল আর পাহাড়। কি খাবে কোথায় থাকবে বুঝতে পারছে না।
এমন সময় বৃষ্টি নেমে গেল। আকাশে অন্ধকার। কার মুখে যেন শুনেছিল আন্দামানে নাকি সারা বছর বৃষ্টি হয় আর হয় যখন তখন। তাহলে এটা কি আন্দামান? কিন্তু আন্দামানে কত লোক বেড়াতে যায় তারা সব কোথায়? এখানে তো কোনও লোকালয় দেখছে না।
দেখতে দেখতে বৃষ্টি বেড়ে গেল। সাগর ঘেরা দ্বীপে নাকি সর্বদাই খুব গরম থাকে। এখানেও তেমন তাই বৃষ্টিটা বেশ ভালই লাগল। কিন্তু যত বাড়তে লাগল ততই মনে হল কিছুর তলায় গেলে বেশ ভাল হত। তাকিয়ে দেখল বেশ কটা ঝাঁকড়া গাছ। আপাতত তাতেই মাথা বাঁচুক।
মিনিট দুই তিনের বেশি গেল না। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ হেসে উঠল। কিন্তু এমন সময় গাছের মাথার দিকে চোখ পড়তেই তার কান্না পেয়ে গেল। ওরে বাবা এ কে রে? আর এ তো নয়। একেবারে সারি সারি কতগুলো শেয়াল ঝুলে আছে পাতা থেকে। অবাক হল সে শেয়ালেরা ঝুলে থাকবে কি করে? কিন্তু শেয়াল এত ছোট হয় কি করে। আর শেয়ালের কি ডানা থাকে? শেয়াল কি উল্টোমুখে শুয়ে থাকলে গাছের ডাল থেকে? লম্বায় ফুট খানেক মাত্র হলেও বিশাল ডানা নিয়ে সে তো অনেক।
মনে পড়ল একটা জন্তুর কথা। সেটা হল বাদুড়। মানে এ হল শেয়ালমুখো বাদুড়? ওরে বাবারে কি ভয়ংকর। শেয়াল সে একেবারেই দেখতে পারে না। শেয়ালেরা বড্ড কামড়ে দেয়। মানুষ খায় কিনা সে সে জানে না। প্রফেসর থাকলে বলতে পারত।
বেশ খানিক অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল ঝুলন্ত দেহগুলো এখনও ঝুলেই আছে। কে জানে ঘুমোচ্ছে কি না? কোন দিকে পালান ঠিক সাগরের দিক নাকি জঙ্গলের দিক এটা ভাবতে না পেরে জলের দিকে দেখল।
দূর থেকে কাউকে যেন বালির ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতে দেখছে। বড় কোনও মানুষ নয়। তার বয়েসেরই একটা ছেলে হবে। ছেলেটা তার বয়েসীই হবে। কিন্তু তার জামাপ্যান্ট সব ভিজল কি করে? আরে এ তো তার অতিপ্রিয় বন্ধু গোবিন্দ। ধুঁকতে ধুঁকতে এসে ধপাস করে বালির ওপর বসে রইল সে।
-আরে গোবিন্দ তোর জামাকাপড় ভিজল কি করে?
অনেক কষ্ট করে বলল গোবিন্দ, প্যারাসুট খুলেছিল ঠিক। নামছিল নিচে। পায়ের নিচে দেখাও যাচ্ছিল বালি। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল কতগুলো উড়ন্ত প্রাণী।
-উড়ুক্কু শেয়াল। ঢোল চেঁচিয়ে উঠল, ওরা শেয়াল নয় বাদুড়। গাছের ডালে ঝুলে থাকে। আকারে খুব বড় রে ঢোল আমি খুব ভয় পেয়েছিলুম। ওই দেখ গাছের ওপর।
-তারপর আমার প্যারাসুটের কাপড় তো ছিঁড়ে ফর্দা ফাঁই। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়লুম সাগরে। মজার কথা যেখানে পড়লুম সেটা পাড় থেকে অনেক দূর বটে তবে জল কিন্তু ছিল খুব কম। আর ঢেউ তেমন জোরাল ছিল না। কিন্তু প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম রে ঢোল। কতক্ষণ যে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেছি তার ঠিক নেই। কিন্তু তোর খবর কি? এখানে কি করে এলি?
-বড় খিদে পেয়েছে রে গোবিন্দ। তোর পেয়েছে?
-পেয়েছে তো ভাই। কিন্তু খাবারের কৌটো তো সব প্রফেসরের আকাশযানের মধ্যে।
ঢোল ভীত হয়ে বলল, আচ্ছা সে আকাশযান কি সাগরের জলে? প্রফেসর তবে-
-চিন্তা করিস না রে ঢোল। এই সাগর দিয়ে কি আর জাহাজ বা উড়োজাহাজ যায় না? আমরা ঠিক সিগন্যাল পাঠিয়ে দেব।
এমন সময় আকাশ কালো করে মেঘ জমল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে তেড়ে এল বীভৎস সেই জন্তুগুলো। ঢোল চেঁচিয়ে উঠল, আবার এসেছে উড়ুক্কু শেয়ালগুলো। সাবধান গোবিন্দ।
উড়ে উড়ে আক্রমণ করতে আসছে বাদুড়গুলো। প্রাণপণে ছুটতে শুরু করেছে তারা। সমুদ্র থেকে দ্বীপের আরো ভেতরে। এখানে জঙ্গলের ঘনত্ব অত বেশি নয়। কিন্তু দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তারা শুনেছে পাহাড়ের নাকি গুহা থাকে। সেখানে এই জন্তু আর বৃষ্টি দুই থেকেই উদ্ধার পাওয়া যাবে।
পাহাড় ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে বটে তবে এখনও বহু দূর। ছুটছে বটে তবে এ আবার কি এক বিপদ। এখানে কি সবই অদ্ভুত? ছাগলের মত কিন্তু আজব বৃহৎ শিংএর অধিকারী এরা কারা। প্রবল বেগে ঢুঁ মারতে ছুটে আসছে তারা কারা?
ছাগল এমন দৌড়তে পারে? বেশ তো ছোট ছোট গাছগুলো খাচ্ছিল আপন মনে। যেই তাদের দেখল অমনি যেন কি হয়ে গেল। ঢুঁ মারতে এগিয়ে এল। আর এই ছোট ছোট গাছের ভেতর দিয়ে দৌড়তে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে যেন।
অবশেষে তারা দেখল চারপাশটা যেন অন্ধকার হয়ে এসেছে। আবার মেঘে ছেয়ে গেল নাকি? না না আনন্দে অধীর হয়ে ঢোল বলল, আমরা একটা গুহায় ঢুকে পড়েছি রে গোবিন্দ।
হ্যাঁ জায়গাটা যে পাহাড়ের গুহা তা বলাই বাহুল্য। আর না পেরে ধপাস করে বসে পড়ল। খিদে তেষ্টা আর ঘুম সব একসঙ্গে এসে যেন জড় হয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু এই গুহার মেঝে কিন্তু পাথুরে বা সমতল নয়। ঘাসের মত কি যেন বিছোন। গুহার একপাশে একটা ফুটো দিয়ে সামান্য আলো যা আসছিল তাতে দেখল সেই ঘাসের গাঁটে গাঁটে একরকম ছোট্ট ডিমের মত ফুল। ঠিক যেমন আমাদের ডিমেশাকে থাকে।
অন্যমনস্ক হয়ে সেই ডিমেফুল একবার মুখে তুলেছিল ঢোল। আরিব্বাস কি মিষ্টি। দারুন খেতে। শুধু ভাল খেতে তাই নয় তেষ্টাও মিটিয়ে দিচ্ছে। দিন গেল রাত এল। রাতটা ভাল কাটবে না ভেবেও তাদের খারাপ কাটল না। এল না সেই উড়ুক্কু গেছো শেয়ালের দল। এল না কিম্ভুত সেই ছাগলগুলোও।
পরের দিন সকালে আলো ফুটতেই বেরিয়ে তাদের চিন্তা হল। এবারে তারা কি করবে?
বাইরে বেরিয়ে ঢোল বলল, ওই দেখ এরোপ্লেন যাচ্ছে। কিছু সিগন্যাল দেখালে হয় না। কিন্তু লাল কাপড় কোথায় পাই?
গোবিন্দ বলল, ধুস এত ওপর থেকে ওরা দেখতেই পাবে না।
-শুকনো কাঠ পুড়িয়ে ধোঁয়া করলে হয় না?
উত্তর না দিয়ে দূরে চেয়েছিল গোবিন্দ হাঁ করে। সেদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ওই দেখ ঢোল।
দূরে পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়া উঠছে। ঢোল বলল, পাহাড়ের মাথায় কারা আগুন জ্বালল বল তো? মানুষ তবে আছে এখানে?
সেটা পাহাড়ের মাথায় না পৌঁছে বুঝি কি করে? আরে দাঁড়া দাঁড়া ওটা কি?
মাথার বেশি ওপরে নয়। ঢোল অবাক হয়ে দেখল উড়ছে তাদের প্রিয় প্রফেসর ক্ষেপচুরিয়াস তার সেই বিখ্যাত আকাশযানে চড়ে।
স্যার। আমরা এখানে স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন স্যার। আমরা এখানে। দুজনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে প্রফেসরের টনক নড়ল। দাঁড় করালেন তাঁর গাড়ি। তারপর নামাতে লাগলেন ধীরে ধীরে।
-স্যার আপনি কি গাড়ি সমেত-
-হ্যাঁ গাড়ি সমেত পড়েছিলুম সাগরে। ঢোলগোবিন্দের রাশি রাশি প্রশ্ন শোনার পরে ধীরে সুস্থে নিজের গল্প বলতে লাগলেন প্রফেসর।
-ভাগ্যি ভাল গাড়িটা আমাকে সঙ্গে নিয়েই পাক খেতে খেতে ভুচ করে সমুদ্রে ডুবে গেল। তোরা জানিস এই আন্দামান সাগরে অনেক প্রবালের পাহাড় আছে। সেই পাহাড়ে আটকে গেলুম। আর অমনি কিলবিল করে ছুটে এল মাছের দল। একটু পরেই এল একটা বিশাল বড় প্রাণী। তার নাম ডুগাং ডুগান।
-সে আবার কি? ঢোলগোবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল।
-সে এক ভারি মজার জন্তু। এটা কিন্তু মাছ নয়। তিমির মত এরা মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। এদের বলে সামুদ্রিক গাভী। এরা আন্দামানের স্টেট এনিম্যাল মানে রাজ্য-পশু।
-তারপর স্যার? ঢোল প্রশ্ন করল। গোবিন্দ বলল, এটা কি আপনাকে কামড়াতে এল স্যার?
-আরে না না এ ভারি ভাল জীব। আমার আকাশগাড়ি তো জলে নষ্ট হয় না। তবে জলে চলেও না তাই একে জলের বাইরে বার করতেই হবে। আমি চেপে বসলুম সেই ডুগাং ডুগানের পিঠে। সে অমনি জলের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কেটে ভুস করে পাড়ের কাছে এসে জলের ওপর উঠে পড়ল।
-এটা কি আন্দামান দ্বীপ স্যার?
-মূল আন্দামান নয়। তার থেকে মানে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বেশ কিছু দূরে। আন্দামান সাগরে অবস্থিত এক নির্জন দ্বীপ। এখানে মানুষ থেকে না একটাও। থাকে অদ্ভুত কিছু জন্তু।
-জানি স্যার জানি- ঢোলের কথা শেষ না হতে হতেই গোবিন্দ বলল, উড়ুক্কু শেয়াল-
-এগুলো আসলে বাদুড়। আকারে বেশ বড় আর মুখটা শেয়ালের মত।
-আবার দত্যি ছাগল। বাপরে কি বিরাট আকার। আর শিং তো নয় যেন গদা।
প্রফেসর বলে উঠলেন, শোন শোন আর অপেক্ষা করা যাবে না এখানে। অনেক কষ্টে আমার আকাশগাড়িটাকে ঠিক করে নিয়েছি। এই দ্বীপে কোনও লোক থাকে না। মানে থাকতেই পারে না। এখানে কোনও ধরণের খাবার পাবে না। শুধু সামুদ্রিক কিছু মাছ ছাড়া। তাই চল উঠে এস। যত তাড়াতাড়ি নাগাদ আমাদের ফিরতেই হবে। গুহার ভেতরের কিছু সেই ঘাসের বীজ রেখেছিল তার যত্ন করে পরে খাবে বলে। এখন নিজেরাও খেল আর প্রফেসরকেও দিল। তারপরে সবাই উঠে পড়ল প্রফেসরের আকাশযানে। উড়তে উড়তে তারা চলল সেই ধোঁয়াওঠা পাহাড়ের চুড়োর দিকেই।
ধোঁয়া কিন্তু ততক্ষণে আর শুধু ধোঁয়া নেই। আগুন উঠছে বেশ। ঢোল ভয় পেয়ে বলল, স্যার আগুন উঠছে স্যার। গোবিন্দ বলল, কেউ নেই যদি তো কে আগুন জ্বালছে স্যার? আগুন ততক্ষণে বেশ বেড়ে উঠেছে। বিরাট বড় বড় স্ফূলিংগ উঠছে অনেক উঁচুতে। আর পাহাড়ের মাথা থেকে আগুন গড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যেন জলের মত তরল আগুন কে যেন হাতা করে ঢেলে দিচ্ছে। প্রফেসর বললেন, ও মাই গড!
ঢোলগোবিন্দ দুজনেই বলল, কি হল স্যার?
-এই আগুন কোনও মানুষ জ্বালে নি। মনে ছিল না এটা ব্যারন দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরে ভারতের একমাত্র জীবিত আগ্নেয়গিরি যে এখানেই।
-আগ্নেয়গিরি! দুজনেই চমকে উঠল।
-হ্যাঁ এই ব্যারন আগ্নেয়গিরি এখনও পর্যন্ত আগুন উদ্গীরণ করে যাচ্ছে। আঠাশ তিরিশ বছর আগে মানে ১৯৯১ সালও সে উদ্গীরণ করেছে। এই আগুন বাড়ার আগে আমাদের এই জ্বালামুখ অতিক্রম করতে হবে।
-কিন্তু আমরা যাব তো স্যার অনেক ওপর দিয়ে। ঢোলের কোথায় প্রফেসর বললেন, এর আগুন আর ছাই আকাশে বেশ কয়েক হাজার ফুট ওপরে ঊঠতে পারে। সেই আগুনের স্পর্শে আমাদের আকাশযান আর আমরা পুড়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাব। গোবিন্দ বলল, আমরা যদি ঘুরপথে যাই?
-সাগরের বিশাল একটা জায়গায় এই আগুন ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের কয়েক হাজার কিলোমিটার ঘুরে যেতে হবে। সেটা সম্ভব নয় আর অত সময় নেই আমাদের হাতে।
বেশ ওপরে আকাশযানকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন প্রফেসর।
ওরা চোখ বড় বড় করে দেখল যেন দুধ উথলে গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের মুখ থেকে। তবে সেই দুধের রঙ একেবারে লাল। সেই সঙ্গে ফুলকি, তাপ আর ধোঁয়া।
ডিরেক্টর কুঞ্জবিহারীর সিনেমা আবার শুরু হবে। ঢোলগোবিন্দের অজান্তে তাদের সঙ্গে লুকোন ক্যমেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন প্রফেসরের সঙ্গেও। তাই সব ছবি উঠে গেছে। এবারের সেই ছবি হবে মারাত্মক। তাতে থাকবে আকাশের চিত্রের সঙ্গে সমুদ্রগভীরের ছবিও। মাছ আর প্রবাল-পাহাড়ের সঙ্গে থাকবে অদ্ভুত জীব ডুগাং ডুগান কিভাবে জলের মধ্যে দিয়ে পাড়ের দিকে বয়ে আনছে প্রফেসরকে। দেখা যাবে সেই অদ্ভুত ছাগল আর শেয়ালমুখো উড়ুক্কু শেয়ালকে।
আর দেখা যাবে আগুন উগরে দেওয়া আন্দামানের ব্যারন স্বীপকে।
________________________________________________________
(ডাঃ) অরুণ চট্টোপাধ্যায়
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)
P.O. BAIDYABATI
DIST. HOOGHLY (PIN 712222)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন