দিঘী ও টিয়াপাখি
অনুরাগ ভৌমিক
অনেক দিনের বায়না এবং স্বপ্ন পূরণ হলো দিঘীর। নাচের ক্লাসে যাওয়া বা আসার পথে এই পাখির দোকান টা দেখে।মাকে বলে ,"মা পাখি কিনবো"
মা বলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে তবে কিনে দেবো।"
যথারীতি হাফইয়ার্লি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে,তাই পাখি কিনে দিতে হবে। যদিও মা'র পাখি পোষা ভালো লাগেনা। পাখিদের খাঁচায় নয়, মুক্ত উড়তে দেখলেই বেশি ভালো লাগে।
আজ শনিবার বিকেল চারটায় নাচের ক্লাস।ফিরতে প্রায় ছয়টা বাজবে। আষাঢ় মাসের সন্ধ্যা একটু দেরি তে হয়। পথের ধারের পাখির দোকানটায় ঢুকে দিঘী ও তার মা। খুব সুন্দর সুন্দর ছোট বড় পাখি।কি ভালো লাগছে।মনে হয় সবগুলো পাখি বাড়ি নিয়ে যায়। একপাশে দেখে তিন চারটা কুকুর ছানা।কুঁই কুঁই ডাকছে। অনেক দেখার পর একটা সবুজ টিয়া পছন্দ করে দিঘী।একটা ছোট্ট খাঁচায় করে দোকানী দিঘীর হাতে দিল।টাকাটা দিয়ে মা ও দিঘী মনের আনন্দে বাড়ি ফিরল।ভাত,লঙ্কা,চাল,গাজর ইত্যাদি অনেক কিছু খায়।রাতে টিয়াটা বেশি খাবার খেলোনা।
রাতে দিঘীর ভালো ঘুম হয়নি। কিছুক্ষণ পর পর জেগে যায়। কখন ভোর হবে।পাখিটাকে দেখতে পাবে।কথা বলতে পারবে।খেলা করতে পারবে। বন্ধুদের ফোন করে বলবে পাখি বৃত্তান্ত।প্রথমে রূপাইকে বলবে,তারপর পরিধীকে,
তারপর একে একে মাসি, পিসি ঠাম্মা,
দিদা ও জ্যেঠতুতু বোন সুনু কে।আহা কি মজা মজা। ঘুমের মধ্যে কথা বললে,মা বলে,"কিরে ঘুমুসনি এখন ও?"
না, মা ভালো করে দেখে ঘুমের ঘোরে কথা বলছে।
ভোর হলো। পূর্ব দিকে ছোট্ট শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়ায়। দিঘীর ঘুম ভেঙে গেছে ছয়টায়। তাড়াহুড়ো করে চলে আসে বারান্দায়। প্রথমে দেখে পাখিটি ঠিক আছে কিনা।দেখে টিয়াটা অনেক আগেই সজাগ।রাতে কি ঘুম হয়নি দিঘীর মতো,দিঘী মনে মনে তা ভাবছে।
"মা ওকে জল দাও, খাবার দাও।"
"দিয়েছি,তোর ভাবতে হবে না।
তুই এখন পড়তে বস।"
"পড়তে বসবো আগে একটু খেলা করে নিই।"
মা চলে কাজে।বাবা যথারীতি ঘুম থেকে উঠে পড়ার আদেশ দিয়ে বাজারে চলে গেলো।এখন টিয়া পাখিটা আর দিঘী।কী সুখ।
হঠাৎ টিয়াপাখি টা বলল,"দিঘী,আমাকে ছেড়ে দাও। আমার এই বন্ধ খাঁচায় আর ভালো লাগে না।"
প্রথমে দিঘী তো অবাক,টিয়াটা এতো ছোট হয়ে ও কথা বলতে পারে। পরক্ষনেই তার কাতর কণ্ঠ শুনে দিঘীর খুব কষ্ট লাগলো।
"ও পাখি,তোমাকে ছেড়ে দিলে আমি খেলবো কার সাথে?তুমি তো উড়ে উড়ে কোথায় দূর বনে চলে যাবে।"
"না গো না,আমি কাছাকাছি থাকবো। তুমি যখন ডাকবে তখনই আমি চলে আসবো।আর তোমার জন্য চকলেট চিপস্ আরও অনেক খাবার নিয়ে আসবো।আর শোনো,আমি কিন্তু অন্য পাখির মতো নই।আমি হলাম জাদু পাখি।আমাকে এক পাখি শিকারী ধরে এনে টাকার লোভে ওই দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে।আসলে জানো,আমি একটা পরী।চার বছর আগের কথা,আমাদের দেশে যে একটা সুন্দর বন আছে, তার কাছেই সুন্দর ঝর্ণা।ওই ঝর্ণার জলে খেলা করছি।এমন সময় এক এক দুষ্টু জাদুকর সেখানে আসে।আমার জাদু দন্ডটা চায়।আমি তা না দেওয়াতে আমাকে একটা পাখি বানিয়ে পৃথিবীলোকে পাঠিয়ে দেয়।দুষ্টু জাদুকর ও পরীলোক থেকে পালিয়ে যায়।সেই থেকে আমি পৃথিবীর বনে বনে ঘুরছি।আমাকে আরও এক বছর এখানে থাকতে হবে।মোট পাঁচ বছর পর আমি পুনরায় আমার পরী রূপ ফিরে পাবো এবং আমার রাজ্যে ফিরে যেতে পারবো।আর কথাটা কাউকে বলো না যেন।"
দিঘী মন দিয়ে কথাগুলো শুনে এবং বলে,"আচ্ছা পাখি,আজকে থাকো,
কালকে কিছু একটা করবো।"তারপর দিঘী চুপচাপ চলে যায়।
পরের দিন সকাল বেলা টিয়াটা একই কথা বলে,পাখিটার কাতর অনুরোধে
দিঘীর মনে গলে যায় ।আর কাল বিলম্ব না করে তাকে সত্যি সত্যি ছেড়ে দেয়।
ছেড়ে দেওয়ার পর কেন জানি দিঘী মনে খুব শান্তি পায়।
মা'র কাছে গিয়ে বলে,"মা টিয়াপাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছি।ওকে খাঁচায় বন্দী দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল।ও কাঁদছিলো জানো।"
মা মনে মনে খুব খুশি হয়। আচ্ছা,ছেড়ে দিয়েছিস তো আর এনিয়ে ভেবে লাভ কী?আর এমনিতে ও পাখিদের বন্দি থাকার চেয়ে মুক্ত আকাশে উড়লেই ভালো লাগে খুব।যাক মা'র ভয় কেটে গেলো।দিঘী ভেবেছিল মা বকবে, সাস্তি ও দিতে পারে। কিন্তু সহজেই মা মেনে নিলো।
পরের দিন দুপুরে মা বাবা ঘুমিয়ে আছে।দিঘী ধীরে ধীরে বাইরে গিয়ে উঠোনের কোণে যে চাঁপাগাছটা আছে, তার তলায় দাঁড়িয়ে ডাকলো,"ও বন্ধু টিয়াপাখি, তুমি এসো,খেলবো।"
সহসা টিয়া পাখিটি প্রকট হয়,বলে,"এই যে বন্ধু আমি এসে গেছি।বলো কী খাবে?
দিঘী মানা করলেও পাখিটি তাকে ডাইরি মিল্ক চকলেট দেয়। আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর আবার আসে সঙ্গে নিয়ে আসে এক প্যাকেট চিপস্।দিঘী তো খুব খুশি।
তারপর টিয়া পাখি ও দিঘী মিলে খুব করে চিপস্ চকলেট খেলো। এমনি করে চলছে দিন।দিঘী ও এই কথাটা কাউকে বললো না। কতোবার রূপাইকে বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বলেনি,কারন বন্ধু পাখিটি কাউকে বলতে নিষেধ করছে। এখানে কথা না রাখলে তো বন্ধুর প্রতি ঠিক হবেনা।
খুব সকালে বা দুপুর বেলা যখন পৃথিবী ঝুম। তখন দিঘীর মন ছুটে বন্ধুর প্রতি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অছিলায় দুই বন্ধু একসাথে হয়।কথা বলে। অনেক স্বাদের খাবার খায়।একটা বিরাট আনন্দের মাঝে দিন কাটে দিঘীর। ইদানিং তো বন্ধুটি তার কাঁধে এসে বসে।কোলে এসে দাঁড়ায়। ঠোঁট দিয়ে আদর করে। দেখতে দেখতে চলে যায় বহুদিন।কত দিন দিঘী এতো হিসাব রাখেনা। দিনের মধ্যে একবার যদি না দেখা হয় তবে মনে কেমন কষ্ট হয়। কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না।
আজ ও কাল সকাল ওঠে বন্ধু পাখিকে ডাকছে। হঠাৎ দেখে একটা সুন্দরী ফুটফুটে পরী এসে তার সামনে দাড়াঁয়।দিঘী অবাক হলো, কিন্তু বন্ধু পাখির জন্য মন ছটপট করছে।পরীটি তখন বলে,"দিঘী আমিই সেই জাদু টিয়াপাখি। তোমার বন্ধু।আজ ভোরে আমার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে।তাই আমি পাখি থেকে পরীতে রূপান্তরিত হয়েছি।আমি আর এই পৃথিবী লোকে থাকতে পারবো না। আমার পরী রাজ্যে এখন চলে যেতে হবে।"
"কী বলছো?তাহলে আমি কীভাবে থাকবো,কার সাথে খেলা করবো? তুমি, তুমি যেও না বন্ধু। এখানে থেকে যাও।"
"না গো না,তার হয়না। আমাকে আমার রাজ্যে ফিরে যেতেই হবে। আমার পরিবার আমার জন্য যে পাঁচটি বছর পর চেয়ে আছে।"
দিঘীর চোখ বেয়ে জল ঝরছে।পরীর ও।
কিছুক্ষণ পর দিঘী বলে,"পরী চলেই যাবে যেহেতু তোমাকে আর থাকতে বলবো না।তবে আবার এসো।"
"যদি পরী রাজ্য থেকে আদেশ পাই তবে তোমার সাথে ঠিক দেখা করতে আসবো।আর শোনো এই নাও একটা জাদু আয়না।এইটাতে বছরে একদিন আমাকে দেখতে পাবে কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় যখন সারা জগৎ জ্যোৎস্না প্লাবিত। সেই সময় এই আয়না মেলে আমাকে ডাকবে। আমাকে দেখতে পাবে, আমিও তোমাকে দেখতে পাবো।"
দিঘী খুব খুব খুশি হলো।মনে একটা বিশাল কষ্ট লুকিয়ে পরী বন্ধু কে বিদায় জানালো।পরীও হাত নাড়াতে নাড়াতে অদৃশ্য হয়ে গেলো।দিঘী চাঁপা গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তখন ও তাকিয়েই আছে।
______________________________________________________________________________________
অনুরাগ ভৌমিক
ছনবন, পোঃ রাধাকিশোর পুর,
উদয়পুর, গোমতী জেলা, ত্রিপুরা।
পিন নম্বরঃ ৭৯৯১২০
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন