অঞ্জনা মজুমদার
ইন্দোনেশিয়া বেড়াতে এসেছে তিন ভাইবোন বাবা মায়ের সাথে। উবুদ থেকে বাটুরে রেস্টুরেন্টের বারান্দা থেকেই আগ্নেয়গিরি আর বাটুর লেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে। আগ্নেয়গিরি শেষবার ১৯৭০ সালে লাভা উদগীরণ করেছিল। ন্যাড়া পাহাড়ের গায়ে লাভা গড়িয়ে পার চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যায়। ওখানে যে ড্রাইভার দাদা এনেছেন তিনি বললন আলাদা ওই আগ্নেয় পাহাড়ের মাথায় অন্য জীপগাড়ি করে ওঠা যায়। রাস্তা পাহাড়ি আর দুর্গম বলে সাধারণ গাড়ি উঠতে পারে না। ওই গাড়ির ভাড়া জনপ্রতি ইন্দোনেশিয়া টাকায় বেশ বেশি। বাবা বললেন, আমরা এখান থেকেই কিন্তামনি আগ্নেয়গিরি দেখি। তোরা পাহাড়ের ওপর থেকে ঘুরে আয়। এমনিতেই ইন্দোনেশিয়ার সমস্ত জায়গায় এন্ট্রি ফি, বোট, জীপগাড়ির ভাড়া বেশ বেশি।
সিমি, আকাশ আর বিনি কিন্তামনি পাহাড়ে উঠার জন্য জীপগাড়িতে উঠেছে। গাড়ি চলছে পাহাড়ি পথে। দুপাশে ঘন বন। সূর্য অস্ত হতে সামান্য সময় বাকি। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। বিনি বলল, দাদাভাই খাদে যদি পড়ে যাই?
আকাশ ধমকে বলল, অত ভয় পেলে আর কোথাও নিয়ে যাবোনা।
তখনি ঝোপের ভেতর দুটো চোখের ঝলকানি আর ঝোপঝাড় তোলপাড় করে গর গর আওয়াজ শোনা গেল। ড্রাইভার বলল, ক্যাচ কেয়ারফুলি, আমাকে জোরে গাড়ি চালাতে হবে।
সিমি বিনির হাতটা জোরে চেপে ধরলো। আকাশও দুই বোনের হাত ধরে ভরসা দিল। জোর ড্রাইভ করে ড্রাইভার একটা আধা সমতল জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাতেই তিন ভাই বোনের মন আনন্দে ভরে গেল।
কিন্তামনি পাহাড়ের উল্টো দিকে সূর্যি মামা লাল চাদর গায়ে পাহাড়ের ওপারে ডুব দিচ্ছেন। আর গোটা আকাশ লাল হলুদ কমলা রঙের হোলি খেলছে যেন। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। তিনজন রাস্তার সব ভয় ভুলে গেল।
জীপগাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে দাদাভাই এর মোবাইল নিয়ে ওদের তিনজনের ছবি নানান পোজে তুলে দিলেন।
তারপর হঠাৎই ঝুপ করে আঁধার নেমে এলো।
ড্রাইভার জন তাড়া দিল, কুইক কুইক, ইট উইল বি ডেঞ্জার।
এখানকার লোকজন ইংরেজি ছাড়া কিছু বোঝে না। মা মাঝে মধ্যে হিন্দি বলে ফেলছিলেন। ছেলেমেয়েরা মিটি মিটি হেসেছে।
ওরা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠতে যাবে অমনি দুটো লোক ছোরা বাগিয়ে দাদাভাই এর সামনে এসে দাঁড়াল।
গিভ অল ইয়োর মানি অর আই উইল কিল ইউ।
বিনি আকাশকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি দাদাভাইকে ছাড়বো না। সিমিও শুকনো মুখে আকাশের পাশে গিয়ে দাদার হাত ধরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলল, উই হ্যাভ নো মানি। উইল ইউ কিল আস? হ্যাভ ইউ নো চিলড্রেন ইন ইয়োর হোম?
ছোরা হাতে লোকদুটো থতমত খেয়ে যেতেই হাতের ব্যাগটা দিয়ে ছোরা ধরা হাতে জোরে ধাক্কা দিল সিমি। হাত থেকে ছোরাটা পড়ে গেল। আকাশ চেঁচিয়ে উঠলো, হে দেয়ার ইজ পুলিশ। লোকদুটো চমকে উঠলো। ড্রাইভারও ওদের তাড়া করতে লোকদুটো দৌড়ে পাহাড়ি রাস্তায় পালাতে গিয়ে পা হড়কে আছাড় খেল।
ড্রাইভার জন চেঁচাচ্ছে, হেল্প হেল্প। একটু দূরে আর দুটো গাড়ি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই গাড়ির ড্রাইভার দুজন দৌড়ে এল। সেই গাড়িগুলো থেকে চারজন তরুণ তরুণী দৌড়ে এলেন। সকলের মধ্যে আকাশের বয়স সবথেকে কম।
হঠাৎই গোটা চারেক বুনো কুকুর ঝোপঝাড় এর আড়াল থেকে লোকদুটোকে ঘিরে ধরলো।
জন বলল, ওঃ! দে উইল কিল দেম। গড, সেভ দেম।
আকাশ হঠাৎ বলল, নো নো ইট ইজ নট ফেয়ার। উই মাস্ট হ্যাভ সেভ দেম।
আকাশের কথা শুনে সব গাড়ির ড্রাইভার আর যাত্রীরা কুকুরদের দিকে ছাতা, টর্চ নিয়ে তেড়ে গেল। কুকুর চারটে খুব ঘেউঘেউ করলেও ধীরে ধীরে পিছু হটে ঝোপের আড়ালে চলে গেল।
এবার লোকদুটো হামাগুড়ি দিয়ে এসে আকাশের সামনে হাত জোড় করে ফরগিভ আস বলে দাঁড়াল।
বিনি বলল, দাদাভাই, ছেড়ে দাও। ওরা তো ক্ষমা চাইছে। সিমিও মাথা নাড়ল।
জন বলল, দে আর নটি পিপলস্। আই উইল কল দ্য পুলিশ।
আকাশ বলল, লেট দেম গো। মে বি দে আর নিডি।
ড্রাইভার জন বললেন, লেট আস ব্যাক।
আকাশ বলল, চলো আমরা ফিরে যাই। বাবা মা চিন্তা করবেন।
ওরা আবার গাড়িতে উঠলো। গাড়ি ধীরে ধীরে চলছিল। বিনি বলল, দাদাভাই দুষ্ট লোকদুটো কি করে আসবে?
জন বললেন ওরা অন্য কোনও গাড়িকে রিকোয়েস্ট করবে নীচে নামার জন্য। তবে ওরা যা দোষ করেছে ওদের পানিশ করা উচিত।
বিনি বলল, হেল্প দেম প্লিজ।
জন বললেন, ইউ ব্রাদার এন্ড সিস্টারস্ অফ ইন্ডিয়া আর গুড।
আকাশ বলল, মানুষ একে অপরকে সাহায্য করবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিনি আর সিমি দাদার কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
নীচে বাবা মা একটু উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওদের ফিরতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উবুদের হোটেলে ফেরার গাড়িতে উঠলেন। তিন ভাই বোনে একে অপরের মুখ চেয়ে মৃদু হাসল। মা বললেন, কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। হোটেলে ফিরে শুনবো। ভাই বোনে চুপ। ঘটনার কথা বলে মাকে চিন্তায় ফেলতে চায়না কেউই।
_______________________________________________________________________________________
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লি বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনি
কলকাতা ৭০০০৮১
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন