Featured Post
গল্প ।। ভূতুড়ে প্রতিযোগিতা ।। মৌসম সামন্ত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ভূতুড়ে প্রতিযোগিতা
মৌসম সামন্ত
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের সেই অঝোরে ঝরে চলা বৃষ্টির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পিকাই। তার চোখ দুটো উদাসীন, মুখটা বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে । পিকাই আমাদের আট বছরের ছেলে, আমি বসে আছি পিকাই এর পাশে। আমার হাতে মোবাইল, তাতে ফেসবুকটা অন করা।মোবাইলে একের পর এক নোটিফিকেশন এসে জমে রয়েছে কিন্তু আমার দৃষ্টি পিকাই এর উপর। পিকাই এমনিতে খুবই দুরন্ত আর ছটফটে, ওর বয়সী বাচ্চারা যেমন হয় আর কি, আজ কিন্তু সে মনমরা হয়ে বসে আছে।
তার এই মনমরা হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে অবশ্য। আসলে আজ রবিবার আমাদের চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা ছিল। পিকাই কোনদিনও চিড়িয়াখানায় যায়নি কিন্তু সারাদিন টিভিতে ডিসকভারি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট দেখে দেখে দেখে কোনটা কি জানোয়ার? কোথায় থাকে? কি খায়? এগুলো একেবারে মুখস্থ। তাই যখন আমি আর ওর মা এই চিড়িয়াখানা যাওয়ার প্ল্যানটা করলাম স্বভাবতই খুব খুশী হয়েছিল পিকাই। এখন তাকে আশাহত দেখে সত্যি খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমার কিছু করারও নেই, বাইরে যেভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে কুকুর বিড়ালও রাস্তায় বের হচ্ছে না। আচ্ছা, ডিসেম্বরের মাসে এই রকম মুষলধারে বৃষ্টি হয় ? বসে বসে সেই কথাই ভাবছি হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। একটু আশ্চর্যই হলাম, এই বৃষ্টির মধ্যে কে এলো আবার। সোমাশ্রী মানে আমার স্ত্রী ড্রইং রুমের সাথে লাগোয়া কিচেনে রান্না করছিল, সেই গিয়ে দরজা খুলল। তার কণ্ঠ স্বর শুনতে পেলাম, সে অতিথিকে আপ্যায়ন করে বলছে, “আসুন আসুন ভিতরে আসুন”। তার গলা শুনে আশ্বস্ত হলাম যে পরিচিত কেউ এসেছে। এরপর সোমাশ্রী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল “দেখ, দেখ, কে এসেছে দেখ”। এরপর আর বসে থাকা যায় না অগত্যা বেডরুম থেকে ড্রইংরুমে এলাম। ড্রইংরুমে এসে দেখলাম দরজার সামনে রুনু জ্যাঠা দাড়িয়ে, পরনে খয়েরী রঙের রেনকোট। পিকাইও আমার পিছন পিছন এসে দাঁড়িয়েছিল, রুনু জ্যাঠাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল জ্যাঠাও সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিলেন। রুনু জ্যাঠা আমার নিজেরজ্যাঠা নন, দুঃসম্পর্কের আত্মীয় ছোট বেলা থেকেই জ্যাঠা বলে ডেকে এসেছি। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতা, মাথা ভর্তি শোন পাপড়ির মত সাদা চুল। ভদ্রলোক জোয়ান বয়সে কুস্তি লড়তেন, রাজ্য স্তরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন পরপর তিন বার। ট্রফি হাতে, মেডেল গলায় তার অনেক ছবিও আমি দেখেছি। কুস্তি লড়তেন বলেই এই সত্তর বছরের উপর বয়সেও তিনি এত ফিট। সোমাশ্রীপিকাইকে উদ্দেশ্য করে বলল “দাদুকে বসতে দাও পিকাই, দাদু অনেক দূর থেকে এসেছেন”। পিকাই জ্যাঠার কোল থেকে নেমে গেল। আমি গিয়ে জ্যাঠাকে একটা প্রণাম করতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর রেনকোটটা খুলে সোমাশ্রীর হাতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন।রেনকোট খুলতে দেখলাম জ্যাঠার পরনে হলুদ রঙের একটা সোয়েটার, আসলে আজ যা ওয়েদার তাতে এই পোশাকটাই সঠিক।
তারপর দাদু ভাই কেমন আছ সব তোমরা ? পিকাইকে জিজ্ঞাসা করলেন রুনু জ্যাঠা।
“আমরা ভালই আছি কিন্তু আপনার দাদু ভাইয়ের মন ভাল নেই আজ”। আমিই উত্তর দিলাম পিকাইয়ের হয়ে।
কেন? কেন? কেন?
“আসলে আজ আমাদের চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকাল থেকে আকাশের যা অবস্থা তাতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না”।
তাই নাকি তা হলে তো খুবই মন খারাপের ব্যাপার।
পিকাই মাথা নাড়ল।
আচ্ছা চিড়িয়াখানায় যখন যাওয়া হল না তখন একটা গল্প হলে কেমন হয়।
গল্পের নাম শুনেই পিকাই উৎসাহিত হয়ে উঠল। সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল হবে।
তুমি কিসের গল্প শুনতে চাও ?
“ভুতের গল্প” পিকাই উত্তর দিল।
রুনু জ্যাঠা একটু খানি চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন “আচ্ছা বেশ, ভুতের গল্পই যখন শুনতে চাও তখন আমার জীবনের একটা ঘটনাই বলব তোমাকে শোন তবে চুপটি করে”।
সোমাশ্রী বলল “আপনি গল্প শুরু করুন জ্যাঠা, আমি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি”।
রুনু জ্যাঠা শুরু গল্প করলেন।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন আমি পঁচিশ বছরের যুবক, কুস্তিতে বেশ নাম ডাক হয়েছে। রাজ্য স্তরে খেলি, তার সাথে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকেও ডাক আসে কুস্তি লড়ার।এই রকমই একবার ডাক এলো হাওড়া উত্তরপাড়া আমরা-কজন ক্লাবের পক্ষ থেকে। জায়গাটা কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে হলেও ক্লাবের উদ্যোক্তারা যেভাবে বাড়িতে এসে অনুরোধ করল তাতে না গিয়ে পারলাম না। গিয়ে পোঁছালাম দুপুর বারোটা নাগাদ। আমার ম্যাচ বিকাল চারটের সময়। গিয়ে শুনলাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হল নবযুবক সঙ্ঘের নবীন পাল। নবীন পালও তখন রাজ্য স্তরে খেলে। আমি যেমন আমরা-কজন ক্লাবের হয়ে এসেছি নবীন তেমন এসেছে নবযুবক সঙ্ঘের হয়ে। আমার আর নবীন পালের মধ্যে তখন প্রবল রেষারেষি কে বাংলার সেরা কুস্তীগির তা নিয়ে। তাই প্রতিপক্ষ হিসাবে নবীনকে পেয়েশরীর আলাদা একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আমার মনে হয় নবীনও একই রকম উত্তেজিত ছিল। ম্যাচ হল হেব্বি হাড্ডাহাড্ডি একবার ও আমায় চিত করে তো একবার আমি ওকে। চার রাউন্ডের লড়াইয়ের পর দুজনেই সমান পয়েন্ট দাঁড়াল। অবশেষে পঞ্চম রাউন্ডে গিয়ে আমি জিতলাম। জেতার পরে আমাকে নিয়ে ক্লাবের সদস্যদের সে কি নাচানাচি। আসলে আমার আর নবীনের মত এই দুই ক্লাবও একে অপরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, সে দুর্গা পূজার প্যান্ডেল হোক বা ক্রিকেট ম্যাচ।
ম্যাচের পর একটা পুকুরে স্নান করতে গেলাম, একাই গেলাম অবশ্য। জায়গাটা বেশ নিরজন বুজলাম এদিকটায় বড় একটা কেউ আসে না। চারিদিকে বড় বড় তাল গাছে ঘেরা মাঝখানে পুকুর। শীতকালের সময়, তাই এই বিকাল সাড়ে পাঁচটাতেও অন্ধকার নেমে এসেছে। তাল গাছের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আমি পুকুর ঘাটের কাছে আসতেই তাল গাছের মাথার উপর বসে থাকা একটা চিল হটাৎ বিকট একটা চিৎকার করে উড়ে গেল। ভয়ডর আমার ছোটবেলা থেকেই কম তাই এই তুচ্ছ ঘটনাকে পাত্তা না দিয়ে বুক ফুলিয়ে স্নানের ঘাট ধরে পুকুরে নেমে গেলাম। পরপর তিনটে ডুবে দিয়ে ঘাট ধরে আবার উপরে উঠছি হঠাৎ আমার একেবারে সামনে দেখি একটা কালো ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তিটার দুইজোড়া লাল চোখ, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরচ্ছে, দেখেই আমি ভয়ের চোটে দু পা পিছিয়ে যেতে গেলাম পুকুরের ঘাট পিচ্ছল হওয়ার কারনে পা হড়কে পড়ে গেলাম ঘাটের উপরেই।যখন জ্ঞান ফিরল শুনতে পেলাম কারা যেন চাপা স্বরে কথা বলছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম উঠার সময় মনে হল শরীর খুব হাল্কা হয়ে গেছে, যেন কোন ওজনই নেই আমার। উঠে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া। দেখলাম দুটো কালো কালো মূর্তি দাড়িয়ে, তাদের একজনের কান গুলো কুলোর মত, আর একজনের মুলোর মত দাঁত মুখের দুদিক থেকে দুটো বেরিয়ে রয়েছে। ভয়ের চোটে আমার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে গেল ভূঊঊঊত। শব্দ পেয়ে কুলোর মত কান ওয়ালা ভুতটা আমার দিকে ফিরল তারপর লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলতে লাগল, “দাদার হুঁশ ফিরেছে, দাদার হুঁশ ফিরেছে”। এই শুনে পাশের মুলোর মত দাঁত ওয়ালা ভুতটাও খুশিতে নাচতে লাগল। এদের দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম কিন্তু এবার এদের কাণ্ড দেখে হাসিই পেল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলাম তোমরা কারা? কি হয়েছিল আমার? প্রশ্নটা শুনে মূর্তি-দুটো তাদের নাচ থামিয়ে দিল। কুলোর মত কান ওয়ালা লোকটা বলল আমি হলাম মামদো ভুত আর মুলোর মত দাঁত ওয়ালা ভুতটাকে দেখিয়ে বলল ও হল গেছো ভুত। গেছো তার দাঁত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে একটু হাসল।
আমি মামদোকে প্রশ্ন করলাম “তা ভাই তোমরা এখানে কি করছ”?
এর উত্তরে মামদো বলল আপনাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে এসেছি।
আমি প্রায় আঁতকে উঠে বললাম “কোথায়”?
তেপান্তরের মাঠে।
তেপান্তরের মাঠ, সেটা আবার কোথায়? বাপের জন্মে নাম শুনিনি বাপু।
সেটা এখান থেকে সাড়ে তিন মাইল।
তা ভাই বলছি কি সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছ কেন?
আরে মশাই প্রতিযোগিতাটা তো সেখানেই তো হচ্ছে। রেগে জবাব দিল মামদো।
কিসের প্রতিযোগিতা ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতা। মামদো একটু রেগেই জবাব দিল।
প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতা সেটা আবার কি?
মামদোটা দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বলল “আপনি না বড্ড বেশী প্রশ্ন করেন। চলুন আমদের সাথে, নিজের চোখেই সব দেখতে পাবেন”।
গেছো ভুতটা মামদোকে বলল “আরে ভাই চটছিস কেন দাদা তো আমাদের এখানে নতুন তাই কিছু জানে না। আমি সব গুছিয়ে বলছি, আচ্ছা দাদা শুনুন তবে,” আমার দিকে ফিরে গেছো বলতে শুরু করল।
আমাদের ভুতদের জগতে প্রতি বছর আমরা একটা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে থাকি। দেশ-বিদেশের নানা ভুত সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে। আমাদের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন গুরুদেব। তিনিই পুরো বিষয়টা পরিচালনা করেন আমরা তার আদেশ অনুসারেই কাজ করি”।
আমি বললাম তা ভাই বেশ কর, তোমার ভুতেরা মিলে অনুষ্ঠান কর, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন কর এত খুব ভাল কথা। কিন্তু আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন।
“বলেন কি দাদা, আপনি যে আমাদের অনুষ্ঠানের একজন প্রতিযোগী। এ বছর আমদের দিশি ভুতদের হয়ে আপনাকেই যে কুস্তি লড়তে হবে”।
কিন্তু আমি কি ভাবে কুস্তি লড়ব ?
কেন যে ভাবে একটু আগে লড়লেন। আমরা দূর থেকে পুরো খেলাটাই দেখেছি। কড়া গলায় মামদো বলল।
গেছো আবার বলতে শুরু করল, “আমাদের হয়ে আগে কুস্তি লড়ত কালী চরণ, আজ বিকলেই সে স্বর্গ লাভ করছে। সেই জন্য গুরুদেব তো রেগে খুন, আমাদের ধমক দিয়ে বলল, যেখান থেকে পারিস একজন কুস্তিগিরকে খুঁজে নিয়ে আয়। আমরা তাই আপনার কাছে এলাম। চলুন দাদা আমাদের সাথে না হলে আমদের দিশি ভুতদের আর মান সম্মান থাকবে না”।
আমি কালী চরণকে কোনদিন দেখিনি। তবে এককালে কুস্তির জগতে কালী চরণের যে খুব সুনাম নাম ছিল সে কথা জানি, কিন্তু আজ পনেরো বছর আগে প্রতিযোগিতা চলাকালীন সে হার্ট ফেল করে মারা গেছে।
আমি বললাম, “কিন্তু আমি সেই প্রতিযোগিতায়কিভাবে অংশ করতে পারি, ওটাতো ভুতেদের প্রতিযোগিতা আর আমি যে মানুষ”।
কথাটা শুনে দেখলাম মামদো আর গেছো হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে চেয়ে থাকলাম, বুজলাম না আমি কি এমন বললাম যে এরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্রায় আড়াই মিনিট পর হাসি থামিয়ে মামদোটা বলল “আপনি এখনো বুজতে পারেননি যে আপনি মারা গেছেন, ডানদিকে তাকিয়ে দেখুন আপনার পুরানো শরীরটাকে”। বলেই আবার খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে লাগল।
কথাটা শুনে আমরা বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। আস্তে আস্তে ডানদিকে ফিরে দেখলাম, একজন মানুষ শুয়ে রয়েছে ঠিক আমার মত দেখতে। ভয়ে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। বুজলাম ওই যে তখন পা পিছলে পড়ে গেছিলাম তখনই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আমার মৃত্যুঘটেছে।
“চলুন দাদা, ওদিকে আবার দেরী হয়ে যাবে”। গেছো ভুত তাড়া লাগাল।
আমি চাইলে নাও যেতে পারতাম, কিন্তু একা একা আমি করবই বা কি আর যাবই বা কোথায়? তার চেয়ে বরং এদের সাথে গিয়েই দেখি কি ব্যাপার।
অগত্যা এদের সাথে ভেসে চললাম তেপান্তরের মাঠের উদ্দেশ্যে। ভেসে বলছি এই কারনে, যে আমি বুজতে পারছি আমি হাঁটছি না, কারণআমার পা মাটিতে পড়ছে না। পা মাটিতে পড়লে যে ওজন অনুভব করা যায় আমি সেটা অনুভবকরতে পারছি না।
যেতে যেতে জানতে পারলাম এই প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতাটা হয় দেশী ভুত বনাম বিদেশী ভুতের। যে দল এই প্রতিযোগিতায় জেতে তাদের ট্রফি দেওয়া হয় আর যে সকল প্রতিযোগী জয়ী হয় তাদের ভুতদের সমাজে কদর অনেক বেড়ে যায়।
মাঠে পৌঁছে আমি তো একেবারে অবাক। রীতিমত মেলা বসে গেছে মাঠে। চারিদিকে থিক থিক করছে ভুত, মামদো গেছো পেত্নী শাঁকচুন্নি এই সব দেশি ভুত তো আছেই তার সঙ্গে বিলিতি ভুতেরও ছড়াছড়ি, গোবলিন, ড্রাকুলা, জম্বি কে নেই সেখানে। তারা কেউ গল্প করছে, কেউ কেউ হাসছে, কেউ আবার মেলার বিভিন্ন দোকান থেকে জিনস পত্তরও কিনছে। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে চোখ পড়তে দেখলাম একটা মঞ্চ করা হয়েছে সেখানে। মঞ্চটা মাঠ থেকে অনেকটাই উঁচুতে। কিছু ভুত মঞ্চের উপর একটু পিছন দিকে চেয়ার পেতে বসে আছে। এরই মধ্যে একটা কঙ্কাল মঞ্চের সামনের দিকে এসে ঘোষণা করল, “আপনারা সবাই দয়া করে ধৈর্য ধরুন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে”। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম এইসব দেখতে দেখতে, হঠাৎ কাপড়ে একটা মৃদু টান পড়তেই চমকে গেলাম। চেয়ে দেখি একটা বাচ্চা গোবিলন আমার কাপড়ের মধ্যে লুকাতে চেষ্টা করছে, আর একটা একটা গোবলিন, সে এই বাচ্চাটার চেয়ে একটু বড় তাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে, তারা ধরাধরি খেলছিল। আমি ভয়ে একটু পাশে সরে গেলাম, হটাত ওই কিম্ভুত জন্তুগুলো গায়ে উঠলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা দেখে মামদোটা বাংলা আর ইংরাজি মিশিয়ে গোবলিন দুটোকে বেশ জোরে ধমক দিয়ে বলল “এই খোকা হুয়াই তোমরা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছ, গো টু ইওর বাবা, মা”। ধমক খেয়ে বাচ্চা গোবলিন দুটো কিছুক্ষণ তাদের ষাট ওয়াটের বাল্বের মত জ্বলজ্বলে চোখে মামদোর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল তারপর ভ্যা ভ্যা করে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। ওই রকম কিম্ভুত জন্তুটা গায়ে উঠতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল কিন্তু তাদের ওই ভাবে কাঁদতে দেখে খারাপ লাগছিল।
“চলুন দাদা এবার মঞ্চের দিকে যাওয়া যাক”গেছো আবার তাড়া লাগাল।
মঞ্চের সামনে গিয়ে মামদো ভুতটা একেবারে মাঝখানে বসে থাকা একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল “গুরুদেব আমরা পালোয়ানজীকে নিয়ে এসেছি”। গুরুদেবটি আমাকে মঞ্চের উপরে উঠে আসার জন্য ইশারা করলেন। এই গুরুদেব ভুতটির উচ্চতা বেশি নয়, মাথা জোড়া টাক, বিরাট ভুঁড়ি, গলায় পৈতে। একে দেখে আমার গল্পে শোনা ব্রহ্মদৈত্যের কথা মনে পড়ে গেল। বুঝলাম গুরুদেব আসলে একজন ব্রহ্মদৈত্য।
মঞ্চে উঠে দেখলাম সারি সারি ভুত সেখানে বসে,মঞ্চের মাঝখানে একটা কাপড় মোড়া টুলের উপর একটা বেশ বড় ট্রফি রাখা। মঞ্চের একেবারে বাঁ দিকে একটা সাদা ঘোড়া দাড়িয়ে আছে, ঘোড়াটা এতটাই সাদা যে মনে হচ্ছে তার সারা শরীর থেকে যেন সাদা আলো বের হচ্ছে। ঘোড়ার ঠিক পাশে, মখমলের গদি পাতা চেয়ারে বসে আছে একটা পেত্নী, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই পেত্নীটা মুচকি হাসল আমিও প্রত্যুত্তরে বোকার মত একটু হাসলাম। পেত্নীর পাশের চেয়ারে বসে আছে একটা শাঁকচুন্নি, পরনে সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা টানা, মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তার পাশের চেয়ারটাতে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম, সেখানে বসে রয়েছে একটা বিরাট রাক্ষস, তার চেয়ারটা বাকি চেয়ার গুলোর তিন গুন, তার পুরোটা জুড়েই বসে আছে রাক্ষসটা। তার গায়ের রঙ সবুজ, মাথার দু পাশে দুটো শিং, চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মত জ্বলছে। তার চোখে চোখ পড়তেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
রাক্ষসের পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে একটা বেতাল। বেতালটার মাথার চুল পুরো সাদা গায়ের চামড়া কুঁচকানো। বয়সের ভারে সে সোজা হয়ে বসতে পর্যন্ত পারছে না। বেতালের পাশের চেয়ারটা খালি, সেই খালি চেয়ারের পাশেই একটা সিংহাসন, সেখানেই বসে আছে ভুতেদের গুরুদেব, মানে ব্রহ্মদৈত্য। তার পাশেই আর একটা একই রকম সিংহাসন সেখানে বসে একটা ড্রাকুলা, মানে ভাম্পায়ার। তার মুখের দুদিকে সরু সূচের মত দাঁত বেরিয়ে। সিংহাসন দেখে বুজলাম দেশি ভুতদের সর্দার যেমন ব্রহ্মদৈত্য তেমনি বিদেশি ভুতদের সর্দার ড্রাকুলা।
ড্রাকুলার পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে একজন লম্বা চওড়া নিগ্রো ভুত। চেহারা দেখে মনে হল একজন ব্যায়াম বীর। তার পাশের চেয়ারে বসে একটা জম্বি। জম্বির পাশের চেয়ারে বসে একটা জিন ভুত। রাক্ষসটার মত এর চেহারাও বিশাল, তবে এর গায়ের রঙ নীল, সারা মাথায় চুল নেই শুধু পিছন দিকে ঝুটি বাঁধা। দুই কানে ঝুলছে বড় বড় দুটো দুল। জিনের পাশে পরপর দুটো চেয়ারে দুজন মেম ভুত বসে। প্রথম জনের পরনে নীল রঙের পোশাক অপর জনের লাল রঙের। লাল পোশাক পরা মেম ভুতের পাশের বিদেশী যুবককে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। ফরসা টুকটুকে মুখ, লম্বা সোনালী চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, মুখে একটা হাসি লেগে রয়েছে সব সময়। কিন্তু ও কি? কোমর থেকে নিচের অংশটা কোথায় ? নিচের অংশটা নেই, তার যায়গায় রয়েছে একটা কালো ঘোড়ার শরীর। আমার মনে পড়ে গেল রোমান উপকথার সেই প্রাণীর কথা যার শরীরের উপরের অংশটা মানুষের আর নিচের অংশটা ঘোড়ার। “সেনটার”, এই নামই দেওয়া হয়েছে তাদের রোমান উপকথায়।
এই পর্যন্ত বলে রুনু জ্যাঠা থামলেন, তার পর পিকাইকে প্রশ্ন করলেন সে্নটরের নাম শুনেছ নিশ্চয় দাদুভাই।
“হ্যাঁ, হ্যারী পটারের গল্পে পড়েছি”। লক্ষ করলাম পিকাই এর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় ভরপুর। একটু আগে যে মনমরা ভাবটা ছিল সেটা একেবারে উধাও।
চায়ে একটা চুমুক দিয়ে রুনু জ্যাঠা আবার শুরু করলেন, এরপর ভুতদের গুরুদেব মানে ব্রহ্মদৈত্য আমাকে ইশারা করল তার পাশের খালি চেয়ারে বসার জন্য। আমি সেখানেই বসলাম। ব্রহ্মদৈত্য এবার কঙ্কালটাকে ইশারা করে কিছু বলল,কঙ্কালটা আবার মঞ্চের সামনে এসে দর্শকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করল, “আমরা আমাদের প্রতিযোগিতা শুরু করতে চলেছি, আমাদের প্রথম প্রতিযোগিতা হল দৌড়। দিশি ভুতদের তরফ থেকে প্রতিযোগী হল সাদা ঘোড়া”। দর্শকেরা হাততালির মাধ্যমে স্বাগত জানাল প্রতিযোগীকে। “বিলিতি ভুতেদের তরফ থেকে এই পর্বের প্রতিযোগী হল রুডি আর ও হল একজন সে্নটর”। কঙ্কালের কথা শেষ হতে না হতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল সারা মাঠ। সোনালি চুলের সেনটরও হাত নেড়ে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করল। দুই প্রতিযোগীকে মাঠের ধারে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে তাদের খেলার নিয়ম বুজিয়ে দিল একটা স্কন্ধকাটা। মাঠের প্রান্ত বরাবর তিন বার প্রদক্ষিণ করে আবার শুরুর জায়গাতেই ফিরে আসতে হবে। যে আগে শেষ করবে সেই হবে বিজয়ী। দৌড় শুরু হল, দুজনেই প্রায় সমান সমান কেউ কারোর চেয়ে কম যায় না। আমি মঞ্চের উপরে বসে প্রতিযোগিতা উপভোগ করছি। মাঠ থেকে অনেকটা উপরে হওয়ার জন্য আর পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সারা মাঠ ভরে যাওয়ার কারনে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রথম প্রদক্ষিণ প্রায় শেষ হওয়ার মুখে, দুই প্রতিযোগী সমান ভাবে পাল্লা দিচ্ছে একে অপরকে। হঠাৎ একটা জিনিস দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সাদা ঘোড়াটার পিঠের দুদিক থেকে লম্বা লম্বা পালক বের হতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে সেই পালক গুলো ডানার আকার নিলো। দেখলাম ঘোড়াটা আর ছুটছে না, সে তার ডানায় ভর করে উড়ে চলেছে। মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়া আর সে্নটরের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেল অনেক। আমি বুজলাম এটা যে সে ঘোড়া নয় এ হল রূপকথার জগতের পক্ষীরাজ ঘোড়া। সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া আকাশের বুকে ডানা মেলে উড়ে চলল আর দেখতে দেখতেই তেপান্তরের মাঠ তিনবার প্রদক্ষিণ করে আবার মাটিতে নেমে এলো। সে্নটর ততক্ষণে সবে দু বার প্রদক্ষিণ করতে পেরেছে।
মঞ্চে পক্ষিরাজ আর রুডিকে পাশাপাশি দাড় করানো হল। একটা মেছো পেত্নী মঞ্চের উপর উঠে এলো, তার হাতে একটা সোনার থালা, সেই থালায় রয়েছে একটা মেডেল। কঙ্কাল এবার বিদেশি ভুতদের সর্দার ড্রাকুলাকে এসে বিজয়ীকে মেডেল পরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। ড্রাকুলা এসে পক্ষিরাজকে মেডেল পরাতেই হাততালিতে গমগম করে উঠল মাঠ। রুডিও সেই সঙ্গে যোগ দিল, মনে মনে রুডির এই স্পোর্টস ম্যান স্পিরিটকে কুর্নিস জানলাম।
কঙ্কালটা আবার দর্শকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করল, “আমাদের পরের প্রতিযোগিতা মহিলাদের ডবলস ব্যাডমিন্টন। দিশি ভুতেদের পক্ষ থেকে এই পর্বের প্রতিযোগী হল মেছো পেত্নী আর শাঁকচুন্নি অপর দিকে বিদেশী ভুতেদের পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে লায়লা আর সুজান”। দর্শকরা আবারও হাততালির মাধ্যমে প্রতিযোগীদের স্বাগত জানল।
আমাদের মঞ্চের সামনে খোলা মাঠের কিছুটা অংশ নিয়ে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটা। দুই দল একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খেলা শুরু করল। হাত মেলানোর সময়ই দেখলাম শাঁকচুন্নিটা কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে আছে। ভয়ে না লজ্জায় সেটা বুজলাম না। যাইহোক খেলা শুরু হল, লাল পোশাক পরা লায়লা সার্ভ করল। পেত্নীটা কোন মতে সেটাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিতেইদর্শকেরা হাততালিতে ফেটে পড়ল, কয়েকটা চ্যাংড়া ভুত খুব জোড়ে সিটিও বাজিয়ে উঠল। পেত্নীটার মুখ দেখলাম লজ্জায় লাল হয়ে গেল। এদিকে পেত্নীর ফেরত পাঠানো কর্ক সুজান নামের নীল পোশাক পরা মেম ভুতটা খুব সহজেই আবার দেশি ভুতেদের কোর্টে পাঠিয়ে দিল। আর এবারেই শুরু হল গণ্ডগোল, কর্ক এলো শাঁকচুন্নির কাছে কিন্তু তার ব্যাট চলল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল, কর্ক মাটিতে পড়ে গেল, সেই সঙ্গে বিদেশি ভুতেদের খাতায় এক পয়েন্ট যোগ হল। শাঁকচুন্নিটাকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে পেত্নীটা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “হতভাগী মারবি তো”।শাঁকচুন্নি কোন উত্তর না দিয়ে একই ভাবে দাড়িয়ে রইল।
এই রকম আরও কয়েকবার হল। শাঁকচুন্নির কাছে যতবার বল যায় প্রতিপক্ষ ততবার পয়েন্ট পায়। শেষে থাকতে না পেরে পেত্নীটা “মুখ-পুড়ি এখানে দাইরে থাকতে এয়েচ” বলে হাতের ব্যাটটা দিয়ে সজোরে শাঁকচুন্নির পিঠে কষিয়ে দিল। পিঠে পড়তেই শাঁকচুন্নি ক্যাই করে উঠল, একটুক্ষণ পিঠে হাত বুলিয়েই তার হাতের ব্যাটটা সে পেত্নীর পিঠে বসিয়ে দিয়ে বলল, “আঁটকুড়ীর বেটি, ছোড়া গুলো ওই ভাবে দেখছে, আমার লজ্জা করে না বুঝি”। পেত্নীটাও আবার ঝাঁঝিয়ে উঠল “কতা শোন গো বুড়ির, ভূতকাল পার হতে চলল, বলে কিনা ওই হাঁটুর বয়সী ভুত গুনোকে নজ্জা পাচ্চে”।
ব্যাস এই কথা শুনেই শাঁকচুন্নি তার লাজলজ্জা সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পেত্নীর উপর “আমি বুড়ি”। এরপর চলতে লাগল দুই ভুতের চুলোচুলি, কামড়া কামড়ি, মারামারি, সঙ্গে মুখের ফুলঝুরি। কেউ তাদের আলাদা করতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত তাদের ধরে মাঠের বাইরে করে দেওয়া হল, দেখলাম তারা তখনো চুলোচুলি করে চলেছ।
এই ঘটনার পর আর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না তাই বিদেশি ভুতদের দলকেই জয়ী বলে ঘোষণা করা হল। যদিও খেলা চালিয়ে গেলেও পেত্নী আর শাঁকচুন্নির জুটির জেতার কোন সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না। ব্রহ্মদৈত্য নিজের হাতে লায়লা আর সুজানকে মেডেল পরিয়ে দিলেন।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কঙ্কাল বলতে শুরু করল “এই প্রতিযোগিতার পরে দিশি ভুত আর বিদেশি ভুত দুই দলের পয়েন্ট সংখ্যা হল এক। এবার আমারা আমাদের তৃতীয় প্রতিযোগিতা শুরু করতে চলেছি। তাই দর্শকদের কাছে অনুরোধ তারা মাঠের মাঝখানটা ফাঁকা করে মাঠের ধারে গিয়ে দাঁড়ান”।
কঙ্কালের কথা শেষ হতে না হতেই দেখলাম প্রায় পনেরো কুড়ি জন বিভিন্ন জাতের ভুত মিলে দর্শক সরানোর কাজে নেমে পড়ল। দু মিনিটের মধ্যেই ভিড়টা মাঠের ধারে ছড়িয়ে পড়ল আর মাঠের মাঝখান গোল করে ফাঁকা হয়ে গেল। দেখে মনে হল এইবার বুজি উপর থেকে কোন ভিনগ্রহী যান এসে এখানেই নামবে। এরপর কঙ্কাল দুই প্রতিযোগী, রাক্ষস আর জিনকে মাঠে নামার জন্য অনুরোধ করতে দুজনেই মাঠে নামল। একে অপরের সঙ্গে হাত মেলানোর পরেই শুরু হল মল্ল যুদ্ধ। মাঠের সব দর্শক মাঠের ধারে ধারে দাড়িয়ে আর মধ্যিখানে দুই বিশাল দেহী প্রতিযোগী একে অপরের মুখোমুখি।
প্রথমেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একে অপরের থেকে অনেকটা তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর তারা একে উপরের দিকে দৌড়ে আসতে লাগল, তাদের পায়ের চাপে মাটি কাঁপতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কাঁপতে লাগল আমাদের মঞ্চ। তারা যখন একে অপরের সাথে ধাক্কা খেলো আমার মনে হল প্রবল ভূমিকম্প হল। সেই সঙ্গে দুটো পাহাড়ে ধাক্কা লাগলে যে রকম বিকট আওয়াজ হতে পারে সেই রকম আওয়াজ হল।
বেতালটা দেখলাম চেয়ার থেকে পড়ে মঞ্চের মাঝখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এদিকে একে অপরের সাথে ধাক্কা লাগার ফলে তারা দুজনেও মাঠের দুই প্রান্তে ছিটকে পড়েছে। সারা মাঠ নিঃশব্দ হয়ে গেল কারোর কোন সারা শব্দ নেই। প্রায় চার মিনিট পর রাক্ষসটা কোন রকমে উঠে বসল, জিনটা তখনও সেই রকমই পড়ে। রাক্ষসটাকে উঠতে দেখে বাচ্চা ভুত আর বাচ্চা গোবলিন গুলো কেঁদে উঠল। আমারও কেমন যেন একটা ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হতে লাগল এইরকম বীভৎস খেলা না হলেই ভাল হত। রাক্ষসটা উঠে গিয়ে জিনটার চুলের মুঠি ধরে তুলল। তারপর তাঁকে তার কাঁধে তুলে একটা আছাড় মারল। মাঠের মাটি গভীর গর্ত হয়ে গেল জিনটা ভারে। আমি মনে মনে ভাবলাম আর একটা এই রকম আছাড় দিলে জিনটা নির্ঘাত মারা যাবে। এদিকে রাক্ষসটা জিনটাকে তুলে আবার আছাড় মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় রেফারী স্কন্ধকাটা বাঁশি বাজিয়ে দিল। রাক্ষসটাও জিনটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল। জিনটার আর দাঁড়ানোর শক্তি নেই সে সেখানেই পড়ে গেল। প্রায় তিরিশ চল্লিশটা ভুত মিলে এরপর জিনটাকে কাঁধে তুলে মঞ্চের পিছন দিকে নিয়ে শুইয়ে দিল। আমিও গেলাম তাকে দেখতে, সে তখন অজ্ঞান। দেখলাম ব্রহ্মদৈত্য বাবা একটা শিশিতে থাকা সবুজ রঙের তরল জিনের মুখে ঢেলে দিল। কিছুক্ষণ পরেই জিনটার জ্ঞান ফিরে এলো।
এরপর মঞ্চে ফিরে ব্রহ্মদৈত্য বাবা রাক্ষসকে মেডেল পরিয়ে দিলেন।
পরের প্রতিযোগিতা হল দড়ি টানাটানি। এই পর্বে দেশি ভুতদের পক্ষ থেকে প্রতিযোগী বেতাল আর বিদেশি ভুতদের পক্ষ থেকে প্রতিযোগী হল জম্বি। দুই প্রতিযোগী মাঠের নির্দিষ্ট যায়গায় পৌঁছাতেই স্কন্ধকাটা তাদের খেলার নিয়ম বুজিয়ে দিল, নিয়ম ছিল এই রকম একটি দড়ির একপ্রান্ত জম্বি অপর প্রান্ত বেতাল ধরবে। তাদের দুজনের মাঝখানে একটা দাগ কাটা থাকবে যে অপরজনকে টেনে দাগের এপারে অর্থাৎ নিজের দিকে নিয়ে আসতে পারবে সেই হবে জয়ী। মনে মনে ভাবছিলাম এই পর্বে দেশি ভুতদের পরাজয় নিশ্চিত কারণ বেতালের যা দশা তাতে জম্বি দড়ি ধরে একটা টান দিলেই বেতাল উড়ে তার কোলে এসে পরবে।
কিন্তু বাস্তবে তা হল না। বেতাল তার রুগ্ন শরীর নিয়ে কোন রকমে দড়ি টানতেই জম্বি দড়ি ছেড়ে তার কাছে আসতে লাগল। রেফারি স্কন্ধকাটা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা থামিয়ে দিয়ে জম্বিকে তার যায়গায় ফেরত পাঠাল। কিন্তু পাঠালে কি হবে আবার খেলা শুরু হতেই একই কান্ড জম্বি আবার দড়ি ছেড়ে বেতালের দিকে যেতে লাগল। আসলে জম্বিকে স্কন্ধকাটা খেলার নিয়ম কিছুতেই বোঝাতে পারছিল না। যতবার বাঁশি বাজিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় জম্বি ততবার দড়ি ছেড়ে বেতালের দিকে হাঁটতে লাগে। শেষে স্কন্ধকাটা হাল ছেড়ে দিল। এইসময় দর্শকদের মধ্যে থেকে একটা গোবলিন বলে উঠল “আমি কি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি”?
গোবলিন হল বিদেশী ভুতদের একেবারে নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্গত। তাই বিদেশী ভুতদের বেশীর ভাগই গোবলিনটার কথায় বিশেষ পাত্তা দিতে চাইল না, কেউ কেউ চটে লাল গোবলিন হয়ে কি করে সবার মাঝখানে কথা বলে? তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে। অল্প কিছু বিদেশী ভুত গোবলিনের হয়ে বললেও বেশীর ভাগিই বিপক্ষে। এইসময় ড্রাকুলা মঞ্চের উপর থেকে সবাইকে শান্ত হতে বললেন আর বললেন “আমাদের হাতে উপায় নেই গোবলিন যদি জম্বিকে খেলার নিয়ম বোঝাতে পারে তাহলে আমরা জেতার একটা সুযোগ পাব না হলে আমরা হেরে যাব। আর তাছাড়া আজ এই আনন্দের দিনে কেউ ছোট বড় নেই সবাই সমান, তাই গোবলিনকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক”। এরপর আর কোন বিদেশী ভুত আপত্তি করল না।
ড্রাকুলা গোবলিনকে অনুমতি দিতে সে জম্বির সামনে এসে বধিরদের যেভাবে ইশারার মাধ্যমে বোঝানো হয় সেই ভাবে হাতের ইশারায় তাকে কি করতে হবে বুঝিয়ে দিতে লাগল।
স্কন্ধকাটা আবার বাঁশি বাজাল, এবার কিন্তু জম্বি আর বেতালের দিকে গেল না বরং সে দড়ি ধরে টান দিতে বেতালটাই তার দিকে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে স্কন্ধকাটা জম্বিকে বিজয়ী ঘোষণা করল।
বিদেশী ভুতদের মধ্যে খুশীর হাওয়া খেলে গেল। যে ভুত গুলো গোবলিনটাকে বাঁধা দিচ্ছিল তারাই তাকে কোলে তুলে মহানন্দে নাচতে লাগল। মঞ্চে উঠার পর ড্রাকুলা জম্বিকে মেডেল পরিয়ে দিল। তারপর জম্বি আর বেতাল নিজেদের যায়গায় গিয়ে বসল, দেখলাম বেতালটা তখনও হাঁপাচ্ছে।
কঙ্কাল আবার ঘোষণা করল “এইবার আমাদের শেষ প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে আর এখনো পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতার ফলাফল দুই দুই অর্থাৎ এই শেষ পর্বে যে দল জিতবে তারাই হবে এই বছরের প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতার বিজয়ী। এই পর্বে হবে কুস্তীর লড়াই, বিদেশী ভুতদের হয়ে তাতে অংশ গ্রহণ করবে লুকা দ্যা জায়ান্ট”। নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার আর সিটির শব্দে মাঠ কেঁপে উঠল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কঙ্কাল আবার বলল “দেশী ভুতদের হয়ে মাঠে নামবে রুনু পালোয়ান”। কঙ্কালের কথা শেষ হতেই দেখলাম পুরো মাঠ চুপ হয়ে গেছে। এতটাই যে পিন পড়লেও যেন শব্দ পাওয়া যাবে। নীরবতা ভেঙে একটা দিশি ভুত প্রশ্ন করল কালু পালোয়ান কোথায়? আমরা কালু পালোয়ানকে চাই। বাকি দেশী ভুতেরাও তার সঙ্গে যোগ দিল, সারা মাঠ জুড়ে রব উঠে গেল “কালু পালোয়ানকে চাই” বলে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্রহ্মদৈত্য উঠে দাঁড়ালেন। তাকে উঠতে দেখে রবটাও থেমে গেল। ব্রহ্মদৈত্য বললেন “আজ বিকালেই কালু পালোয়ান মানে আমাদের কালী চরণের স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটেছে তাই সে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারল না”। আমাকে দেখিয়ে ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “কালী চরণের বদলি হিসাবে আমরা রুনু পালোয়ানকে এনেছি, ইনিও খুব ভাল কুস্তীগির আপনারা এনাকে সমর্থন করুন”।
ব্রহ্মদৈত্যের কথায় কেউ বিশেষ ভরসা পেল বলে মনে হয় না কিন্তু তার মুখের উপর কেউ কিছু বলতে পারল না।
আমি আর আমার নিগ্রো প্রতিদ্বন্দ্বী লুকা দুজনে মাঠে নামলাম। সবে ভুত হওয়ার পরে হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল আমার পা যেন মাটিতে পড়ছে না, এখন সেই ব্যাপারটা অনেকটা কেটে গেছে। আসলে ভুত হওয়ার পর শরীরের ওজন আর থাকে না শুধু থাকে আত্মার ওজন, যেটা খুবই সামান্য তাই ওই রকম মনে হচ্ছিল। খেলার শুরুর আগে হাত মেলানোর সময় লুকা আমার হাত বেশ জোরেই চেপে ধরল। আমার মুখ দিয়ে মৃদু স্বর বেরিয়ে এলো, সেটা দেখে লুকা একটা তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেসে আমার হাতটা ছেড়ে দিল।
কুস্তীর মাঠে আমরা অনেক সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি পরীক্ষা আর নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে এই ভাবেই হাত মিলিয়ে থাকি। এতে খেলার শুরুতে একটা মনস্তাত্ত্বিক জয় পাওয়া যায়, আমার বিষয়টা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল।
খেলা শুরু হল, প্রথমেই লুকা আমার কোমর ধরার জন্য নিচু হয়ে এগিয়ে এলো আমিও বুদ্ধি করে তাকে পাশ কাটিয়ে তার পিছনে চলে গেলাম। পিছন থেকে তাকে ঘুরিয়ে মাটিতে ফেলার জন্য কোমর ধরে হেঁচকা টান দিলাম কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমি তাকে এক ইঞ্চিও উপরে তুলতে পারলাম না উল্টে সেই আমাকে শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল। এই ঘটনায় আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। এই নিগ্রোর চেয়ে আরও লম্বা চওড়া মানুষের সাথে আমি কুস্তি লড়েছি, তাদেরকে শূন্যে তুলে আছাড়ও দিয়েছি, কিন্তু একে পারলাম না কেন? একে তুলতে গিয়ে মনে হল যেন পাহাড় তুলছি। খেলার চলাকালীন বেশী ভাবলে চলে না তাই সব চিন্তা ভুলে পরের রাউন্ডের জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু এবারেও একই অবস্থা হল আমার। আমি লুকাকে এক চুলও যায়গা থেকে নড়াতে পারলাম না অথচ সে আবার আমাকে পুতুলের মত তুলে মাটিতে আছাড় মারল। ওদিকে বিদেশী ভুতেরা সারা মাঠ লুকা লুকা শব্দে কাঁপিয়ে তুলেছে আর দিশি ভুতেরা সব চুপচাপ।
দর্শকদের মাঝে চোখ পড়তে দেখলাম মামদো আর গেছো করুন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি দিশি ভুতদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাদের মুখ গুলও হতাশায় ভরে উঠেছে। আমার চোখ পড়ল মঞ্চের উপর থাকা ব্রহ্মদৈত্য বাবার উপর দেখলাম তিনি নির্বিকার। আমি জানি মুখ দেখে বোঝা না গেলেও তিনিও খুব টেনশনে আছেন। নিজের উপর খুব রাগ হল, এই ভুত গুলো আমায় ভরসা করে মাঠে নামিয়েছে আর আমি কিনা প্রায় বিনা লড়াইয়ে গো হারান হারছি। ঠিক করলাম এইভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কোন ভাবেই হারব না। একভাবে না হলে অন্য ভাবে চেষ্টা করব।
আবার প্রস্তুত হলাম পরবর্তী রাউন্ডের জন্য এটাই আমার কাছে শেষ সুযোগ কারণ সব মিলিয়ে পাঁচ রাউন্ডের খেলা তার মধ্যে লুকা দুটো জিতে গেছে। আমাকে জিততে হলে পরের সবকটা রাউন্ড জিততে হবে। লড়াই শুরু হল, এবার কিন্তু আমি লুকাকে শূন্যে তোলার চেষ্টা করলাম না বরং দেশী পায়তারা ব্যবহার করলাম। লুকা দৌড়ে এসে আমাকে আবার চাগিয়ে তুলে ফেলার মতলব করছিল, আমি প্রায় মাটিতে শুয়ে লুকার পায়ের মধ্যে নিজের পা ফাঁসিয়ে দিলাম ফলে লুকা পায়ে পা জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল ব্যাস ওমনি আমি ওঁর পিঠে উঠে পড়লাম। রেফারিও সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে দিল। সেই সঙ্গেই দেশী ভুতদের মধ্যেও আবার প্রাণ ফিরে এলো তারাও হুল্লোড় শুরু করে দিল। লুকা লুকা রব বদলে গেল রুনু রুনু রবে। পরের রাউন্ডের জন্য আবার প্রস্তুত হলাম এবারও ঠিক আগের বারের মত একই কায়দায় লুকাকে চিত করলাম। রেফারি বাঁশি বাজাতেই মাঠে যেন শব্দের বিস্ফোরণ ঘটল। দিশি ভুতদের চিৎকারে কান পাতা দায় হল। এই রাউন্ডের পর স্কোর দাঁড়াল দুই দুই। ওদিকে দিশি ভুত বনাম বিদেশী ভুতের প্রতিযোগিতার ফলাফলও দুই দুই অর্থাৎ পরবর্তী রাউন্ড যে জিতবে সেই হবে এই পর্বের বিজয়ী আর তার দল হবে এই বছর প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতার বিজয়ী।
শেষ রাউন্ড শুরু হল, আমরা দুই প্রতিযোগীই এই রাউন্ডে অনেক বেশী সাবধানী। কেউ কারোর দিকে বেশী আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছই না। দু জনেই জানি এই রাউন্ডের মূল্য। এই সময় হঠাৎ আমি একটু সুযোগ পেয়ে গেলাম লুকাকে তুলে আছাড় দেওয়ার জন্য যদিও পরে বুজেছি লুকাই আমায় সুযোগ করে দিয়েছিল যাতে তাকে কোমর ধরে চাগিয়ে তুলতে যাই। আমি তার কোমর ধরতেই সে ঘুরিয়ে আমাকে তার দু হাতে ধরে শূন্যে তুলে দিল, এক মুহূর্তের জন্য সারা মাঠ চুপ হয়ে গেল। আমি বুজলাম আর আমার বাঁচার কোন উপায় নেই তাও একটা শেষ চেষ্টা হিসাবে আমি লুকার কান দুটো খামচে ধরলাম। এতে একটা মস্ত লাভ হল সে যেই আমাকে ছুড়ে ফেলতে গেল ওমনি তার কানে হেঁচকা টান পড়ল আর তাতে তার হাত আগলা হয়ে গেল, আমিও মাটিতে নেমে এলাম। এরপর তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে তার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে তাকে ল্যাঙ মেরে চিত করে দিয়ে তার বুকের উপর উঠে বসলাম। রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই দেশী ভুতেরা একেবারে দল বেধে কোর্টে ঢুকে আমাকে চাগিয়ে তাদের কাঁধে তুলে নাচতে আরম্ভ করে দিল। আমি দিশি ভুতদের কাঁধে চেপেই মঞ্চের দিকে চললাম। মঞ্চে উঠতে ব্রহ্মদৈত্য বাবা হাঁসি মুখে আমাকে মেডেল পরিয়ে দিলেন।
প্রতিযোগিতার শেষে সকল প্রতিযোগী আবার তাদের আগের যায়গায় গিয়ে বসল। কঙ্কালটা মঞ্চের উপর থেকে ঘোষণা করল “এই বছর আমাদের প্রেতপুরীর প্রতিযোগিতার বিজয়ী হল দেশী ভূতের দল”। কঙ্কালের কথা শেষ হতেই দর্শকরা উল্লাসে মেতে উঠল আকাশটা বাজির আলোয় ভরে উঠল। সেই উল্লাসের মধ্যেই কঙ্কাল বিদেশী ভুতদের সর্দার ড্রাকুলাকে অনুরোধ করল প্রতিযোগিতার ট্রফি দেশী ভুতদের সর্দার ব্রহ্মদৈত্যর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। ড্রাকুলা উৎফুল্ল ভাবেই ট্রফি ব্রহ্মদৈত্যর হাতে তুলে দিল। এরপর ব্রহ্মদৈত্য একে একে সব প্রতিযোগীর সাথে হাত মিলিয়ে তাদের অভিনন্দন জানাল। সব শেষে আমার সামনে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন “তুমি আজ আমাদের দিশি ভুতেদের নাম আবার উজ্জ্বল করেছ, গত চার বছর ধরে আমরা এই প্রতিযোগিতায় শুধু হেরেই চলেছি। তুমি আবার আমাদের জয়ের স্বাদ পাওয়ালে। তোমাকে আমি আমার প্রেতপুরীর সেনাপতি করব”।
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, “আজ্ঞে গুরুদেব আমি আপনার প্রেতপুরীর সেনাপতি হতে চাই না। দয়া করে আমাকে বাড়িতে ফেরত যেতে দিন”।
গুরুদেব অবাক হয়ে বললেন “কিন্তু সে কি করে সম্ভব? তুমি যে মারা গেছ। তোমাকে আবার জীবিত করে দিলে যে চিত্রগুপ্ত আমায় গরম তেলে ভাজবে”।
কিন্তু বাবা আমি তো স্বাভাবিক নিয়মে মরিনি। আমাকে যে আপনার চ্যালারা জোর করে মেরে ফেলেছে।
“সে কি রকম”?
আমি এরপর পুকুরে স্নান করতে যাওয়া থেকে এখানে আসা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ব্রহ্মদৈত্য বাবাকে গুছিয়ে বললাম।
শুনে ব্রহ্মদৈত্য বাবা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। তারপর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মামদো আর গেছো ভুতকে ডেকে প্রশ্ন করলেন “ইনি যা বলছেন তা কি সঠিক”?
মামদোটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “জী আজ্ঞে গুরুদেব”।
এরপরেই দেখলাম রাগে ব্রহ্মদৈত্যর চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মত জ্বলে উঠল। কেন তোরা একাজ করেছিস? চিৎকার করে উঠলেন ব্রহ্মদৈত্য বাবা।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গেছো বলল, “আপনি তখন আদেশ দিলেন যে, যেখান থেকে পারিস কুস্তিগির ভুত খুঁজে নিয়ে আয়।
“আমি তোদের ভুত খুঁজে আনতে বলেছিলাম। মানুষ মেরে ভুত বানাতে বলিনি”। বজ্র কঠিন স্বরে বললেন বাবা।
আমাদের ভুল হয়ে গেছে গুরুদেব দয়া করে আমাদের ক্ষমা করে দিন। দুটো ভুত এক সাথে হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইল।
ব্রহ্মদৈত্যর স্বর কিছুটা নরম করে বললেন “ওরে তোরা নয় আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যাবি কিন্তু আমি কার কাছে ক্ষমা চাইব। চিত্রগুপ্ত ব্যাটা এবার আমায় গরম তেলে ভাজবে। এমনিতেই ওঁর সাথে আমার আদায় কাঁচ কলায় সম্পর্ক, সে কি আমাকে শায়েস্তা করার এমন সুযোগ ছাড়বে”।
“আপনি কিচ্ছু ভাববেন না গুরুদেব, আমরা এক্ষুনি গিয়ে পালোয়ানজি কে নিজের শরীরে ফিরিয়ে দেব”। মামদো বলে উঠল।
ব্রহ্মদৈত্য আমার দিকে ফিরলেন আর বললেন “তোমাকে আবার জীবিত করতে পারি কিন্তু শপথ করতে হবে কাউকে এই কথা বলতে পারবে না”।
আমিও শপথ করলাম কাউকে বলব না আমার এই অভিজ্ঞতার কথা।
এরপর মামদো আর গেছোর সঙ্গে আবার সেই পুকুর ধারে ফেরত এলাম। কিন্তু একি আমার বডি কোথায় ? পুকুরের যে জায়গাটাতে আমার মৃত দেহটা থাকার কথা সেই যায়গাটা ফাঁকা পুরো। আশপাশটাও তন্নতন্ন করে কিছুক্ষণ খুঁজলাম আমারা তিনটে ভুত মিলে কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। এই ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম মামদো আর গেছোর দিকে তাকতে দেখলাম ভয়ে তারা কেমন যেন গুটিয়ে গেছে।
এবার কি হবে ? মামদোটাকে প্রশ্ন করলাম। এর উত্তর সে যা দিল তাতে আমার আর একবার হার্ট ফেল হওয়ার জোগাড়। সে বলল “ভোরের আলো ফোটার আগে আপনি যদি আপনার শরীরে প্রবেশ করতে না পারেন তা হলে আর কোন দিন পারবেন না, ভুত হয়েই থেকে যাবেন।আর সেটা হলে, চিত্রগুপ্ত ব্রহ্মদৈত্য বাবাকে গরম তেলে ভাজুন কি না ভাজুন, ব্রহ্মদৈত্য বাবা আমাদের দুজনকে নরকের আগুনে ছুড়ে ফেলে দেবে”। এইটুকু বলেই মামদো ভুতটা ফোঁত ফোঁত করে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। গেছো ব্যাটাও তার সাথে যোগ দিল।
এদের দুটোকে নরকের আগুনে ফেলতে দেখলে বেশ খুশিই হতাম কারণ এদের জন্যই আমার এই দুর্ভগ কিন্তু আমার শরীর খুঁজে না পেলে আমি ভুত হয়েই থেকে যাব আর সেটা আমি কোন ভাবেই চাই না। তাই আমাকে আমার শরীর খুঁজে পেতেই হবে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভোর হতে আর বেশী দেরী নেই যা করার এখনি করতে হবে।
আমি ভুত দুটোকে ধমক দিয়ে বললাম “তোমরা কান্না থামাও দেখি বাপু, এখনো ভোর হয়নি চলো গ্রামের দিকটায় গিয়ে দেখি কেউ আমার দেহটাকে লাস মনে করে তুলে নিয়েও যেতে পারে”।
মনে মনে ভাবছিলাম মানুষ নিয়ে গেলে ঠিক আছে কিন্তু শিয়াল কুকুরে নিয়ে গেলে এতক্ষণে ছিঁড়ে খেয়েছে। কথাটা মনে হতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আমরা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলাম। গ্রাম জনমানব শূন্য চারিদিকে বিরাজ করছে নিস্তব্ধটা। আমারা কুস্তীর ময়দানের সামনে এলাম। এখানেই আজ বিকালেই আমি নবীনকে হারিয়ে ছিলাম। মাঠ ফাঁকা কিন্তু কোলাহলের মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হল পাশেই কোথাও অনেক লোক একসাথে জড়ো হয়ে কথা বলাবলি করছে। মাঠের পাশেই আমরাকজন ক্লাব, মনে হল শব্দটা সেই দিক থেকেই আসছে। আমরাও সেই দিকেই গেলাম, গিয়ে দেখলাম ক্লাবের সামনে বেশ ভিড়। আমরা ভিড় ঠেলে সামনে ঢুকলাম যদিও আমদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ক্লাবের ভিতর ঢুকে দেখলাম, মেঝেতে দুখানা সতেরো ইঞ্চি বিছানো, তার উপরেই শোয়ানো আমার শরীরটা। এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেলাম, গেছো আর মামদো ভুতের দিকে তাকালাম মনে হল তারাও যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গেছো বলল আর দেরী করবেন না দাদা তাড়াতাড়ি নিজের শরীরে ঢুকে পড়ুন। আমি বললাম “আমিও যে তাই চাই কিন্তু কি করে ঢুকতে হয় সেইটাইতো জানি না। গেছো বলল আপনি আপনার শরীরের উপর শুয়ে পড়ুন মামদো তারপর মন্ত্র পড়ে শরীর আর আত্মা এক করে দেবে। আমি গেছোর কথা মত কাজ করলাম। আমি আমার শরীরের উপর শুতেই মামদো মন্ত্র পড়া শুরু করল তার মন্ত্রপাঠ শেষ হতেই আমি আমার শরীরে প্রবেশ করলাম। ক্লাবের সদস্যরা যে যার মত গল্প করছিল, তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হল আমার ডেড বডিটা নিয়ে কি করা হবে। সন্তু বলল “আজ রাতেই শাসানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিলে হত না? হরেন মিত্তির আপত্তি করে বলল “ নানা একেবারেই না। রুনু বাবুর বাড়িতে খবর না দিয়ে কাজটা করা কোন ভাবেই ঠিক হবে না”। নন্দ ঘোষ বলল “কিন্তু এই ভাবে বেশিক্ষণ বডি ফেলে রাখলে গন্ধ ছড়াবে যে”। ক্লাব সেক্রেটারি রাকেশ মজুমদার এতক্ষণ সকলের কথা শুনছিলেন, এবার তিনি বললেন“সকাল হতে আর বেশী দেরী নেই। সকাল হতেই আমাদের কোন এক সদস্যকে কলকাতায় পাঠানো হবে। সেই গিয়ে রুনু পালোয়ানের বাড়িতে খবর দেবে। তারপর বডি কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে”।
এদিকে আমি প্রাণ ফিরে পেতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম আর আমাকে উঠতে দেখেই ক্লাব সদস্যরা ভুত ভুত বলে যে যেদিকে পারল ছুটতে আরম্ভ করল। আমিও সেই সঙ্গে চেঁচাতে চেঁচাতে লাগলাম আমি ভুত নয়, আমি ভুত নয়, আমি বেঁচে আছি তোমরা সব ফিরে এসো। আমার ডাক একটু দেরিতে হলেও তাদের কানে পৌঁছেছিল। প্রথমে রাকেশ মজুমদার, তারপর একে একে বাকি সব সদস্যরা ফিরে এলো। আমাকে ছুঁয়ে দেখল আমি সত্যি বেঁচে আছি কিনা। তারপর আশ্বস্ত হতে আমকে প্রশ্ন করল আমার কি হয়ে ছিল? আমি বললাম পুকুরে স্নান করে উঠার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম তারপর আমার কিছু মনে নেই।
আমি এবার প্রশ্ন করলাম আমি এখানে কি করে এলাম। হরেন মিত্তির বলল “আপনি পুকুরে স্নানকরতে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও যখন ফিরলেন না আমরা সব দল বেঁধে পুকুরের দিকে আপনাকে খুঁজতে গেলাম। গিয়ে দেখি ঘাটের উপর আপনি পড়ে আছেন অজ্ঞান অবস্থায়। তারপর আপনাকে ধরাধরি করে ক্লাব ঘরে এনে শোয়ানো হল। যদু ডাক্তারকেও খবর দেওয়া হল। যদু ডাক্তার এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন আপনি আর বেঁচে নেই”। এই পর্যন্ত বলে হরেন মিত্তির পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন। দেখলাম আমরাই ডেড সার্টিফিকেট মৃত্যুর কারণ দেখানো রয়েছে হার্ট ফেল।
কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকাতে ক্লাব সদস্যদের মাঝখানে দেখলাম মামদো আর গেছো দাড়িয়ে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই তারা ফিক করে একটু হাসল তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে মনে মামদো আর গেছোকে ধন্যবাদ দিলাম কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাকে অলৌকিক জগতের অংশ করে তোলার জন্য। পরদিন সূর্যের আলো ফুটতেই বাস ধরে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গল্প শেষ হতে রুনু জ্যাঠা আদুরে গলায় পিকাইকে প্রশ্ন করলেন, কি দাদুভাই কেমন লাগল গল্পটা? খুব ভাল বলে পিকাই আনন্দের চোটে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুনু জ্যাঠার কোলে।
______________________________________________________________________________________
মৌসম সামন্ত
16, শাঁখারি টোলা স্ট্রিট, কলকাতা-700014, ভারত।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন