প্রতিভার বিকাশ
সমীর কুমার দত্ত
শান্ত ওরফে শান্তনু দুলে বছর আট দশেকের ছেলে, পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। যেখানে যা গান বাজে তা সে মাইকেই হোক আর কোন ফাংশনেই হোক বা টিভিতেই হোক যেখানেই গান হবে ছুটে যাবে এবং মন দিয়ে শুনবে। গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইবে। এই ভাবে গাইতে গাইতে বেশ ভালো গানের ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। গরীরের ঘরের ছেলে তাই, নাহলে বড়ো লোকের ঘরের ছেলে হলে হৈচৈ পড়ে যেতো। ছোটাছুটি পড়ে যেতো মাষ্টার খোঁজার জন্য। বাপ মা ওর গান শোনে আর হাসে। মা রেণুকা দুলে তার কাজের মাঝে মাঝে ছেলের গান শোনে আর স্বামী হারাণ দুলেকে বলে, "বেশ ভালো গান গায় আমাদের ছেলেটা। গলাটাও বেশ সুন্দর তাই না? শুনে শুনে গান গুলো বেশ তুলে নিয়েছে। মায়ের কথা শুনে বাবা বলে, " হলে হবে কী। গরীবের ঘরে আবার গান! গান শুনে তো আর পেট ভরবে না। তার চেয়ে লেখাপড়াটা ভালো করে শিখলেই হয়। কিছু করে খেতে পারবে। শুনে মা বলে, "আমাদের মতো ঘরে কি আর লেখাপড়া শিখবে! ভালো মাষ্টার দিতে পারলে তবে যদি হয়। বড়ো বড়ো ঘরের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে বসে আছে। কাজ কই ?
—আমাদের ঘরে একটা পাশ দিলেই কাজ পেয়ে যাবে। এখন তফসিলি জাতির জন্যে কাজের কোটা না কি বলে,তাই আছে। তবে ভালো ফল করতে হবে।
হারাণরা হলো তফসিলি জাতি। পদবী দুলে। এই শ্রেণীর লোকেরা গ্রাম গঞ্জে পালকি বহনকারী ছিলো। কালক্রমে পালকির ব্যবহার উঠে গেলে তারা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভবতঃ তাদের এই পেশা থেকে 'দুলে' কথাটি এসেছে। সে যাই হোক, হারাণ ও তার স্ত্রী রেণুকা ঘরে ফুচকা তৈরি করে আর হারাণ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বাজারের মুখে বিক্রি করে। আজকাল ফুচকা খুব বিক্রি হয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সাফ হয়ে যায়। সংসারটা কোন মতে চলে যায়। ছেলেকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। ছেলের পড়াশোনার থেকে গানে মন বেশি টানে। সব সময়ই গুন গুন করে গান গেয়ে চলেছে। পাড়ায় ওর সম বয়সীরা ওর গান মুগ্ধ হয়ে শোনে। কথাটা তাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার ক্লাবের বড়ো সদস্যরা ওকে ক্লাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর গান শোনে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলাবলি করে, "ছেলেটার প্রতিভা আছে। না হলে এরকম অ্যাকিউরেট গায় কি করে ? "
আবার কেউ বলে, " ছেলেটা কাদের ছেলে? থাকে কোথায়?"
উত্তরে কেউ বলে," ওই যে রে বাজারে দাঁড়িয়ে যে লোকটা ফুচকা বিক্রি রে। চিনতে পারছিস না?
—ও হো, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই লোকটার ছেলে? বাঃ, কিন্তু হলে কি হবে। গরীবের ঘোঁড়া রোগ!
— দেখ, কোন তালিম পায় না। তাতেই এতো সুন্দর গায়। আমাদের যখন ফাংশান হবে, একে দিয়ে গান গাওয়াবো।
ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে, " চিন্তা করিস্ না। আমরা তোকে বড়ো শিল্পী বানিয়েই ছাড়বো।"
শান্তু স্কুলে থাকলেও গুন গুন করে গান গেয়ে যায়। কেউ পছন্দ করে তো আবার কেউ করে না। একদিন ক্লাসে মণি মাষ্টার পড়াচ্ছেন। শান্তু পাশের এক ফাঁকিবাজ ছেলেকে গুন গুন করে গান শোনাচ্ছিলো। পাশের অন্য এক ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে বলে উঠলো,
" স্যার, শান্তু বসে বসে গান গাইছে। নিজে পড়া শুনছে না আর আমাদেরও শুনতে দিচ্ছে না।"
মণি মাষ্টার পড়া থামিয়ে শান্তুকে বললেন, উঠে দাঁড়া । আমি যা পড়িয়েছি শুনেছিস্ ?"
— না।
—গান গাইছিলি। বলি এটা কি গানের ক্লাশ ! উঠে আয়।
শান্তু ভয়ে গুটি গুটি পায়ে উঠে এলো।
— এখানে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক।
মণি মাষ্টার আবার পড়াতে শুরু করলেন। শান্তু কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
কিছুদিন পর স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হবে। কেউ আবৃত্তি, কেউ গান, কেউ নাচ ,যারা যা শিখছে,নাম দিচ্ছে। মণি মাষ্টার শান্তুকে বললেন, "সেদিন খুব তো ক্লাসে গান গাইছিলি। আসল জায়গায় গা । গেয়ে দেখা। বেশ কয়েকটি ছাত্র , যারা শান্তুর গান শুনেছে, তারা জোরে বলে উঠলো," হ্যাঁ স্যার, ও খুব ভালো গান গায়। ওকে নাম দিতে বলুন। মণি মাষ্টার বললেন, "বটে, গান গায়, তা একটা গান শোনা দেখি। ক্লাসে তো একটা পড়া পারিস্ না। দেখি গানটাও পারিস্ কিনা।"
শান্তু পরম উৎসাহে নেচে উঠলো। সবাই মজা হবে ভেবে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসি মুখ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। এমনকি হারাণ মাষ্টারও। শান্তু গান ধরলো। "চরণ ধরিতে দিও গো আমারে/নিও না নিও না সরায়ে -----------"
মণি মাষ্টারের মুখ গুরু গম্ভীর হয়ে উঠলো। গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনে গেলেন। গান শেষ হয়ে যাওয়ার পর পর্যন্ত তিনি এক ভাবের মধ্যে বিরাজ করছিলেন। কখন গান থেমে গেছে ওনার হুঁস ছিলো না। ছেলেরা সব মণি মাষ্টারের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হঠাৎ হুঁস ফিরে এলে তিনি বললেন,
" আহা, কী শুনলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলবো না।" শান্তুকে কাছে ডেকে বললেন, "এ গান তুই এই বয়সে গাইলি কি করে? তুই কি কারোর কাছে গান শিখিস্?"
শান্তু শান্তভাবে কিছু না বলে শুধু অসহায় দৃষ্টিতে ঘাড় নাড়লো। বিষন্ন মনে যে কথাগুলো ঘুরে ফিরে বেড়ায় তা হলো — "আমরা গরীর স্যার,গান কি শিখবো। খেতেই তো ঠিক মতো পাই না। কিন্তু এই মনটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না স্যার— গান আমাদের জন্যে নয়। তবু শোনে না। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। আটকাতে পারি না স্যার। আমি জানি না গানগুলো কিভাবে বেরিয়ে আসে। আমার তো বিশেষ কোন সঙ্গী নেই। গানই আমার সঙ্গী। যেদিন এই গান আমায় ছেড়ে যাবে আমি চলে যাবো। আর ফিরবো না।
মণি মাষ্টার শুধু বললেন," শান্তু তুই শুধু ঘাড় নেড়ে অনেক কথা বলে দিলি। তার উত্তর আমার জানা নেই। তোর মন যখন চায় তুই গান গেয়ে যা। স্বাধীনতা দিবসের দিন তোর গানই প্রথম হবে। তুই আয় আমার সঙ্গে। তোকে আমি এক জায়গায় নিয়ে যাই।" বলে মণি মাষ্টার শান্তুকে নিয়ে চললেন পাড়ারই এক ওস্তাদজীর কাছে। গিয়ে বললেন, " ওস্তাদজী, এলাম আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে।
এই ছেলেটার কণ্ঠে একটা গান যদি শোনেন।
ওস্তাদজী জিজ্ঞাসা করলেন,
"কে এই বালক?"
মণি মাষ্টার শান্তুর সম্বন্ধে সব বৃত্তান্ত খুলে বলে ওর গলায় একটা গান শোনার অনুরোধ রাখলেন ।
ওস্তাদজী শান্তুকে গান ধরতে বললেন। শান্তু গান ধরলো — 'মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান'----- ধরলো ভানুসিংহের পদাবলী।
এস্তাদজী চোখ বুজে মাথা দোলাতে লাগলেন। গান থেমে গেলে ওস্তাদজী বললেন," সাধু, সাধু! প্রতিভাবান এ বালক!
পূর্ব জন্ম থেকেই ও তৈরি।"
মণি মাষ্টার বললেন, "ওর শিক্ষার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। ওর বাবার তো ক্ষমতা নেই। আপনার যা পারিশ্রমিক তা আমি দেবো। তা বলে তো একটা প্রতিভাকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।"
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওস্তাদজী বললেন, আপনি গানের শিক্ষক না হয়েও ওর দায়িত্ব নিতে চাইছেন। আর আমি গানের শিক্ষক হয়ে এ দায়িত্ব নিতে না পারলে সেটা লজ্জার। আপনি প্রকৃত শিক্ষক। আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। সেই থেকে শান্তু ওস্তাদজীর কাছে তালিম নিতে থাকলো তাঁরই যন্ত্র ব্যবহার করে। ওস্তাদজী তালিম দিয়ে ওর সুপ্ত প্রতিভার অক্লান্ত জাগরণ ঘটাতে লাগলেন বারুদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো। অচিরেই ও অনেক পরিণত হয়ে উঠলো।
স্বাধীনতা দিবসের দিন অনুষ্ঠানের শুরুতেই শান্তু ধরলো —" ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা-------" গানের মধ্যে দিয়ে সকলকে দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুললো। সকলেই শান্তুকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। সেই থেকে অবহেলিত শান্তু হয়ে উঠলো সঙ্গীতের এক প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন উজ্জ্বল নক্ষত্র। কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সঙ্গীতের উচ্চতম প্লাটফর্মে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সকলকে বিস্মিত করে জিতে নিলো সঙ্গীতের সর্বোচ্চ শিরোপা। যা ইতিহাসে প্রথম। স্পষ্টতা, নিয়ন্ত্রণ, সুরের গভীরতা, আবেগের প্রকাশ ,স্বরের বৈচিত্র্য , ভোকাল টেকনিক ও ভয়েস রেঞ্জ কী নয় সবেতেই প্রতিভা বিকাশের স্ফূরণ ঘটলো। অর্থাভাবের সঙ্গে ছিলো সঙ্গীত প্রতিভা যার হাত ধরে অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটলো হারাণ দুলে ও রেণুকা দুলের জীবনযাত্রার মান। আর ঘটলো শান্তনু দুলের হাত ধরে তফসিলি জাতির উত্থান।
________________________________________________________________________________________
Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন