সোহমের বিস্ময়
আরতি মিত্র
আজ খুব ভোরে সোহমের ঘুম ভাঙল,বিছানায় হাত বাড়িয়ে দেখলো,মা কোথায় ? সে অবাক হয়ে ভাবলো, এতো সকাল সকাল মা উঠে যায়! নিজেকেই নিজে বললো, মায়ের তো অনেক কাজ একটু পরেই সোহম বলবে ," ওমা, মা, খুব খিদে পেয়েছে , কিছু খেতে দেবে? তখন মাকে তো খেতে দিতে হবে,তাই না; সেজন্যই মা উঠেছে, মাকে তো আবার অফিস যেতে হবে ,আমাকে স্কুল বাসে তুলে দিয়েই মা বাস ধরবে।"এই কথা ভেবেই সে উঠে মুখ ধুতে গেল,তারও কত্তো কাজ ,ব্রাশ করবে নয়তো দাঁতগুলো সব পট পট করে পরে যাবে । সে ক্লাশ ওয়ানে পড়ে কিন্ত নিজের কাজ নিজেই করতে পারে ।কাল রাতেই বইখাতা গুছিয়ে রেখেছে।
আজ আবার পরীক্ষা আছে ।সে বরাবরই ক্লাশে ফার্স্ট হয়।খুব মন দিয়ে পড়া করে।এবারে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসলো ,এর মধ্যেই মা সব রান্না , দুজনের টিফিন গুছিয়ে ফেলেছে।টিফিন কৌটোটা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, আজ তার পছন্দের খাবার -- পরোটা আর আলুর দম।
মা ধোঁয়া উঠা ভাত ডাল আলুভাজা এনে টেবিলে রাখলো,বললো," সোনা এসো, আমরা খেয়ে নি, দেরী করো না।" সোহম আর মা দুজনেই খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরী হয়ে নিল।একদম সময় নেই।
এই দুজনের ঘর সংসার। আরেক জনও তো থাকবার কথা,অনেকবার জিজ্ঞেস করেও মায়ের কাছ থেকে সোহম কোন উত্তর পায় নি।তার বাবা কোথায়?সে জানে না,জানতে খুবই ইচ্ছে করে কিন্ত কার কাছ থেকে সে জানবে,সবার বাবাকে তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখে তার মনে খুব কষ্ট হয়,তার কেন বাবা নেই।
একবার অবশ্য মা খুব দুঃখ করে বলেছিলো যে, তার মামাবাড়ির অবস্থা ভালো নয় সেজন্য তার বাবা মাকে সবসময় কথা শোনাতো সবার সামনে মাকে অসম্মান করতো। আসলে সোহমের বাবা খুবই অহংকারী মানুষ তাই সর্বদা কথায় কথায় নিজের ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করতো ,শুনে সোহমেরও খুবই খারাপ লেগেছিল কিন্ত সে তো ছোট অতো কথা ভালো করে বুঝতে পারেনি আবার মার কান্না দেখেও কষ্ট পেয়েছিল,শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে মা একটা চাকরী যোগার করে সোহমকে নিয়ে চলে আসে এবং একাই মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
সামনেই পয়লা বৈশাখ , নববর্ষ,প্রতি বছর মা তার জন্য নতুন জামা প্যান্ট, ড্রইং খাতা রঙ পেন্সিল কিনে আনে , সে কথা ভেবেও মনে আনন্দ হচ্ছিল তবে তার আগে পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে হবে ।
আজকের পরীক্ষায়ও সোহম খুব মন দিয়ে লেখে।
ছুটির ঘন্টার সঙ্গে সঙ্গেই মনটা হঠাৎই আনন্দে ভরে যায়,এক্ষুনি মা এসেই বলবে," কি রে সোনা কেমন হলো?"সে তো বলার জন্য তৈরী, কিন্ত কৈ এতক্ষণ হয়ে গেলো ,মা তো এলো না!
দারোয়ান কাকুকে জিজ্ঞেস করেও জানতে পারলো যে , মা এখনো আসেনি।সোহম ভাবতে ভাবতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো,চারপাশ থেকে স্যার,ম্যাম ছুটে এলেন,তাকে আদর করে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন,সে তো শুধু " মা ,মা " বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
হঠাৎই দেখলো সবার মধ্যে খুবই ব্যস্ততা।
কি হলো সোহম বুঝতেই পারলো না।
এরই মধ্যে প্রিন্সিপাল স্যার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ম্যামকে কি যেন বললেন।
ম্যাম সোহমকে কাছে ডেকে আদর করে বললেন, " সোহম চলো তোমার মায়ের কাছে,"
সোহম তো তক্ষুণি চোখের জল মুছে ছুটে এলো।
সকলে সোহমকে নিয়ে রওনা দিল।
সোহমের অনেকবার মনে হলো যে সে জিজ্ঞেস করে তারা কোথায় যাচ্ছে কিন্ত অপেক্ষা করতে লাগলো প্রায় আধঘন্টা পর সে দেখলো গাড়িটা একটা হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল
তার বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো তবে কি মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে নানা ভাবনায় ছোট মনটা তোলপাড় হতে থাকলো সবাই চুপচাপ, কারো মুখে কোনও কথা নেই।
লিফ্টে করে পাঁচতলায় উঠে এলো সবাই।
একটা ঘরের কাছে গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার সোহমকে নিয়ে সেখানে ঢুকে বললেন, "প্রতিভা দেখো কাকে নিয়ে এসেছি "
প্রতিভা সোহমকে বুকের কাছে টেনে নিল।
তারপর প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলল, "আমি জানতাম একদিন তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবে আমাদের কাছে।"
তারপর সোহমের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি বাবার খোঁজ করছিলে না? ইনি তোমার বাবা হন।" সোহম আশ্চর্য হয়ে প্রিন্সিপালের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
বাবা সোহমকে দু হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো,সোহম ভাবল, বাবা তার এত নিকটে ছিল, কিন্তু কখনোই সে ভাবতে পারেনি।
এবারের নববর্ষে সে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পেল।
ভগবান যেন তার জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুললো।
নিজের অজান্তেই কখন যেন মায়ের মতো করে দুটো হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে বললো, " ঠাকুর যা করেন সবই মঙ্গলের জন্যই করেন।"
________________________________________________________________________________________
Arati Mitra.
267/3 Nayabad. Garia.
Kol. 700094
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন