Featured Post

ছড়া ।। আকাশটাকে খোঁজে ।। দীনেশ সরকার

ছবি
আকাশটাকে খোঁজে দীনেশ সরকার            পড়তে বসলে জানলা দিয়ে মন ছুটে যায় দূরে গাইছে পাখি ওই যে গাছে মিষ্টি-মধুর সুরে। কিংবা যখন হাত বাড়িয়ে আকাশ আমায় ডাকে পড়ার পাতায় মন আমার কি বাঁধা তখন থাকে?   পূবের হাওয়া কড়া নাড়ে যখন আমার দোরে কিংবা অলি গুনগুনিয়ে চতুর্দিকে ঘোরে প্রজাপতি পাখা মেলে ওড়ে ফুলের মেলায় কখন যেন অবুঝ এ মন যায় হারিয়ে হেলায়।   কাঠবেড়ালি কাটুস্‌-কুটুস্‌ আমার দিকে তাকায় মন তখন কি আটকে থাকে পড়ার বইয়ের পাতায়? টুনটুনিটা তিড়িং-বিড়িং পুচ্ছ নাচায় গাছে মনটা বাঁধা তখন কি আর অঙ্কখাতায় আছে?   অঙ্ক কষতে ভুল হয়ে যায়, পড়া যাই যে ভুলে স্যারের বকা মাঝে মাঝেই খাই আমি ইস্কুলে। মনকে আমি কত্ত বোঝাই, মন তবু কি বোঝে সুযোগ পেলেই জানলা দিয়ে আকাশটাকে খোঁজে।   ******************************************** দীনেশ সরকার ১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি, প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর---- ৭২১৩০৬

গল্প ।। ভূতের রাজা ও গোপাল ভাঁড় ।। মিঠুন মুখার্জী

 

                 গোপাল ভাঁড়ের মজার ঘটনা

                   ভূতের রাজা ও গোপাল ভাঁড়

                                                       মিঠুন মুখার্জী 

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় রাজামশাই, মন্ত্রী, সেনাপতি, পারিষদবর্গ সকলেই খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। কোথা থেকে কয়েকটা ভূত এসে সারা রাজ্য তোলপাড় করে চলেছিল। কখনো কারো বাড়ি ভাঙচুর, কখনো কারোর গলাটিপে হত্যা, কখনো বাড়ির সমস্ত খাবার খেয়ে নেওয়া, আবার কখনো রাজপ্রাসাদে উৎপাত করেই চলেছিল। ভূতেদের অত্যাচারে রাজামশাইসহ সমস্ত প্রজারা খুবই অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এদিকে ভূতেদের উৎপাতের একদিন আগে থেকেই একসপ্তাহের জন্য গোপাল ভাঁড় রাজদরবার থেকে ছুটি নিয়েছিল। অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য এই ছুটি। একমাত্র শালার বিয়ে উপলক্ষে তাদের স্বামী-স্ত্রীর এই যাত্রা। গোপালের এই আনন্দের দিনগুলিতে কৃষ্ণনগরের এই দুর্দশা চলছিল। সে কোনোভাবেই এই খবর পায় না। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দরবারের সকলের উদ্দেশ্যে বলেন --- " গোপালকে আমাদের এই খারাপ সময়ে খুবই দরকার ছিল। এই ভূতের সমস্যার একটি সমাধান ও নিশ্চয় করে দিত। এমন সময় গোপাল ছুটি নিল, কিভাবে এই যাত্রা উদ্ধার হব বুঝতে পারছি না। এই দরবারে আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যিনি ভূতের হাত থেকে আমাদের রেহাই দিতে পারেন। যে আমায় উচিত বুদ্ধি দেবে কাজ হলে তাকে আমি পুরস্কৃত করব।" মহারাজের কথা শুনে রাজদরবারের কেউ টুশব্দটি করেন না। ভয়তে সকলে ঘেমে যান। মন্ত্রী বলেন ---"মানুষ হলে জব্দ করা যেত মহারাজ, কিন্তু ভূতের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া অত সহজ নয়। একটু এদিক - ওদিক হলেই ঘাড় একেবারে মটকে দেবে। বাবা কী ভয়ঙ্কর রূপ। দেখলে ভয়েতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।" সেনাপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বলেন--- " আমি ভূতেদের দেখিনি মহারাজ। তবে শুনেছি ওদের পিছনে লাগলে প্রতিশোধ না নিয়ে ওরা ছাড়ে না। ওদের মধ্যে খুব একতা আছে, যা জীবিত মানুষদের মধ্যে নেই। এরা যখন বেঁচে ছিল তখন এদের উপর খুব অন্যায় করা হয়েছিল। অন্যায়ভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এদের। তাই এরাও আমাদের রাজ্যের মানুষদের শান্তিতে থাকতে দেবে না বলে পন করেছে।" এরপর মহারাজা সেনাপতিকে বলেন---"আপনি এসব কথা কোথা থেকে শুনলেন? ভূতের দল কানে কানে বলে গিয়েছেন? না সবই আপনার মনগড়া কথা। আমি বুঝতে পারছি ভূতেদের সম্মুখীন হওয়ার সাহস নেই আপনাদের। গোপাল ভাঁড় ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবেন না। গোপালকেই ডাকতে হবে।"মহারাজ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গোপাল ভাঁড়ের শ্বশুরবাড়ি লোক পাঠান। তারা সেখানে গিয়ে কৃষ্ণনগরের অবস্থা খুলে বলেন। সেদিন ছিল গোপালের শালার বৌভাতের পরের দিন। তারা ভেবেছিল বৌভাতের তিনদিন পর বাড়ি ফিরবে। কিন্তু  রাজামশাই ও কৃষ্ণনগরের প্রজাদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে গোপাল সেই মুহূর্তে গিন্নিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। এক মুহূর্ত দেরি না করে রাজদরবারে যান। রাজা গোপালকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হন। তিনি তাঁকে বলেন--- " গোপাল কৃষ্ণ নগরের বর্তমান অবস্থার কথা তোমার হয়তো অজানা নয়। কারো না কারো কাছে তুমি ভূতের উৎপাতের কথা শুনেছ নিশ্চই। এযাত্রা তুমি আমাদের বাঁচাও গোপাল। কী করব এখন বলো তো ভায়া।" গোপাল মহারাজের সমস্ত কথা শুনে বলে--- "আমাকে একটু ভাবার সময় দিন মহারাজ। শ্বশুর বাড়ির আনন্দের দিনগুলির স্মৃতি এখনো মাথা থেকে যায় নি। এই সমস্যার সমাধান আমি যেভাবেই হোক করব। আপনাকে আমার কথা মতো সারা রাজ্যে কটাদিন কিছু নিয়ম পালন করাতে হবে। আমি দেখা করব ভূতের রাজার সঙ্গে।" মহারাজ গোপাল ভাঁড়কে বলেন--- "কী সেই নিয়ম? যদি একটু তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একটু কমত গোপাল। আর তুমি যে ভূতের রাজার কথা বললে, তা সত্যি? তিনি কোথায় থাকেন? খুব সাবধান! তোমার যেন কোনো বিপদ না হয়।" গোপাল হেসে বলে --"আপনি একেবারে চিন্তা করবেন না। আমি এমন কাজ করব যে আমাদের রাজ্য ছাড়তে ভূতেরা বাধ্য হবে। এতদিন কৃষ্ণনগর রাজ্যে যা যা ক্ষতি হয়েছে সব ফিরে পাব আমরা।" মন্ত্রী বলেন -- "গোপাল আমি জানি তুমি বরাবর ভালো গুল মারতে পার। এটা একটু বেশি বলা হয়ে গেল না। যা যা নষ্ট হয়ে গেছে, যাদের যাদের মারা যাওয়ার পর দাহ করা হয়ে গেছে, কোনো পাথিব চিহ্নই নেই---তাদের তুমি কি ভাবে ফিরিয়ে দেবে!! এভাবে রাজামশাইকে সন্তুষ্ট করে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছ তুমি। কথা মতো কাজ না পেলে রাজামশাই তোমাকে কী করবেন আমি জানি না, তবে আমরা কিন্তু তোমায় ছেড়ে দেব না।" মন্ত্রীর কথা শুনে গোপাল হেসে বলে --- "মন্ত্রী মহোদয় আমি যে আপনাদের মতো ফাঁকা আওয়াজ করি না এর আগে তার অনেক প্রমান পেয়েছেন। শূন্য কলসিদের আওয়াজ বেশি হয়। নিজেরা তো কোনদিন কিছু করার চেষ্টা করেন না,কেউ করার চেষ্টা করলে সেটাও আপনারা মেনে নিতে পারেননা। এটা একেবারেই ঠিক নয়।" গোপাল ভাঁড়ের কথায় মন্ত্রী অপমানিত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বলেন---" মহারাজ আপনার সামনে দাঁড়িয়ে গোপাল আমাদের অপমান করছে, এর একটা বিহিত করতেই হবে। একজন ভাঁড় হয়ে ওর এতোটাই সাহস যে আমাদের শূণ্য কলসির সঙ্গে তুলনা করছে। তাছাড়া ওর ভূতের রাজার সঙ্গে আলাপ একেবারে মিথ্যা। ওর ভন্ডামির মধ্যে একদম পড়বেন না। তবে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।" মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বলেন --- "শূন্য কলসিদের কেউ ভরা কলসি বলে? আপনাদের কারো কিছু করার কোনো ক্ষমতা নেই। কেউ করতে গেলে বাঁধা দেওয়া আপনাদের স্বভাব। ভূতেদের উৎপাতের এই দিনগুলোতে যখন গোপাল ছিল না, তখন আপনাদেরকে আমি বলেছিলাম এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে। কিন্তু আপনারা সবাই ভূত ভূত করে মরার আগে মরে নিজেরাই ভূত হয়ে গেলেন। আর আজ গোপালের উচিত কথা খুব সম্মানে লাগছে? গোপাল যে কথাগুলো বলেছে সবই সত্য কথা।" মহারাজের কথায় মন্ত্রী আরো অপমানিত বোধ করেন। কিন্তু চুপচাপ থাকেন।
     গোপাল মহারাজের অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। শালার বিয়েতে সব দায়িত্ব তার উপরেই ছিল। তাই ঠিক মতো ঘুম যেমন তার হয় নি, তেমনি কাজ করে গা হাত পা খুবই ব্যথা। না ঘুমালে তার শরীর আর চলছে না। গোপাল ঠিক করে আজ রাতে বউয়ের রাধা ইলিশ মাছ দিয়ে সকাল সকাল খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়বে। বউ যখন ইলিশ মাছ গোপালের পাতে দিয়ে হাতাটা কড়াইতে রাখে তখন গোপাল দেখে, কড়াই থেকে একটার পর একটা ইলিশ মাছ উধাও হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে এসব ভূতেদের কাজ। তাই নিজের পাতের মাছটি শক্ত করে সে ধরে রাখে যাতে ভূতে নিয়ে যেতে না পারে। অনেক চেষ্টা করে ভূতেরা যখন গোপালের হাত থেকে ইলিশ মাছ নিতে ব্যর্থ হয়, তখন রেগে গিয়ে ভূতেরা গোপালের ভাতের থালা উল্টে দেয়। গোপালও ভূতেদের উপর রেগে গিয়ে বলে--- " তোদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। যত পারিস আর দু-একদিন আমাদের জালাতন করে নে। তোদের রাজার কাছে আমি যাব। এই অন্যায়ের কারন আমি তার কাছে জানতে চাইব। যেমন করে হোক রাজ্য থেকে আমি ভূত তাড়াবই।" গোপালের এই সব কথা শোনার পর ভূতেরা একটা বিকট ভৌতিক  হাসি দেয় এবং গোপাল ও তার গিন্নি সেই হাসি শুনতে পায়। একজন ভূত হঠাৎ গোপাল ভাঁড়ের সামনে প্রকট হয়। সে বলে ---" ভূতের রাজাটা কে রে গোপাল? আমরা কারো বশ নই। তুই কোনো কিছু করেও আমাদের আটকাতে পারবি না। আমরা চাইলে কৃষ্ণনগর একমুহুর্তে শ্মশানভূমিতে পরিনত করে দিতে পারি। কিন্তু একটা বিশেষ মুহূর্তের আমরা অপেক্ষা করছি। একসপ্তাহ পর সেই অমাবশ্যার বিশেষ দিনটি আসবে। আমরা কাউকে জ্যান্ত রাখব না। তুইও মরবি গোপাল, তুইও মরবি।" এই বলে গোপালের বাড়িতে একটা ঝড় তুলে ভূতেরা বেরিয়ে যায়। গোপাল বিষয়টি হালকা ভাবে নেয় না। খুব চিন্তায় পড়ে যায় সে। কীভাবে সবাইকে বাঁচাবে সেই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে নি। ভূতের রাজার যে গল্প গোপাল মহারাজা ও ভূতেদের কাছে করেছে তা সকলের মনে সাহস সঞ্চার করার জন্য। আসলে ভূতের রাজা বলে কেউ আছেন কিনা তা গোপালের অজানা। 
     সারারাত ভাবতে ভাবতে ভোরবেলা গোপাল কখন ঘুমিয়ে পড়ে তা তাঁর মনে নেই। স্বপ্নে সে এমন এক রাজ্যে এসে পৌঁছায় যেখানে কোনো মনুষ্য নেই। চারি দিকে বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড় ছড়ানো রয়েছে। হঠাৎ গোপাল দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো একটি সিংহাসনে একজন ভূত বসে আছেন। তাঁর দুই পাশে দুজন শাকচুন্নি তাঁকে পাখার হাওয়া দিচ্ছে। দেখে মনে হয় ইনিই ভূতেদের রাজা। চারিদিকে শুধু ভূতপ্রেতদের অবস্থান। ভূত নৃত্য চলছে । দুজন ভূত তাকে ভূতের রাজার কাছে নিয়ে গেলে নৃত্য হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ভূতের রাজা গোপালকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচু করে বলেন---"কে তুই? এই ভূত পুরীতে কি করছিস? তোর তো সাহস কম নয়।" গোপাল সাহস করে ভূতের রাজাকে বলে---- "আজ্ঞে রাজামশাই, আমি গোপাল ভাঁড়। কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় বিনোদন প্রদান করি। আমাদের রাজ্যে ভূতদের খুব উপদ্রব বেড়েছে, যে কারণে সুস্থভাবে বাঁচা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। কখনো কাউকে মারছে, কখনো বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, কখনো আবার খাবার খেয়ে নিচ্ছে। সে এক বিচিত্র কান্ড। আগামী অমাবস্যায় তারা কৃষ্ণনগরের সকলের ভবলীলা সাঙ্গ করতে চায়। এটা কি ঠিক, আপনি বলুন? আপনাদের তো একটা নিয়ম-কানুন আছে। আপনাকে না মেনে অন্যান্য ভূতেরা যদি নিজের ইচ্ছা খুশি কাজ করে, তাহলে তো আপনার ঘোর অপমান। এরপর তো আপনাকে কেউ আর ভয় পাবে না! আপনাকে মানবেই না!!" গোপালের কথা শুনে ভূতের রাজা খুব রেগে যান। তিনি গোপালকে বলেন-- "তুই এটা ঠিকই বলছিস। কিন্তু তুই যা যা বলছিস সেটা সত্যি কি করে বুঝবো? মিথ্যাও তো হতে পারে।" ভূতের রাজার কথা শুনে গোপাল ভাঁড় বলে--- "মিথ্যা হলে আপনি আমায় মৃত্যুদণ্ড দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব। আর সত্যি হলে আপনার আমাদের এই সমস্যা সমাধান করে দিতে হবে রাজামশাই। নতুবা আপনাদের এই ভূত পুরি থেকে আমি যাবোই না। চিত্রগুপ্তের খাতায় যাদের এখনো নাম ওঠেনি, তাদের আপনাদের ভূতেরা অকালে মেরে ফেলছে। এ তো ঘোরতর অপরাধ। এরপর এই ভূত জীবন থেকে আপনারা আর কোনোদিন মুক্তি পাবেন না।" গোপাল ভাঁড়ের কথাগুলো মন দিয়ে শুনে ভূতের রাজা বলেন --- " তুই একেবারে ঠিক বলেছিস। আমরা ভূত থেকে মুক্তি না পেলে পুনরায় মানবজনম পাব না। আবার মানুষ হওয়ার আমার খুব ইচ্ছা। এই কে আছিস আমার ভূতদর্পণটা নিয়ে আয় তো।" ভূতের রাজার আদেশ মত একটি ভূত ভূতদর্পণ নিয়ে আসে। ভূতের রাজা দর্পণ উদ্দেশ্য করে মন্ত্র উচ্চারণ করেন। দেখেন -- "পাঁচটি ভূত কৃষ্ণনগরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একে অপরকে বলছে---আর তিনটি দিন অপেক্ষা কর। সবাই মরবে, সবাই।" তাদের অত্যাচারের নমুনাও ওই ভূত দর্পণে দেখতে পান ভূতের রাজা। আগে ঘটে যাওয়া ওই ভূতেদের তান্ডবলীলা দেখতে পান তিনি। তিনি খুব রেগে গিয়ে বলেন--- " ওদের এতো বড় সাহস আমার অনুমতি না নিয়ে এইসব করে বেরাচ্ছে। ওদের একটা ব্যবস্থা আমার করতেই হবে।" এরপর গোপাল ভাঁড়কে তিনি বলেন --- "ভূতের সমস্যা আমি দূর করে দেব। কথা যখন দিয়েছি তখন অবশ্যই রাখব। তার বিনিময়ে আমার একটা কাজ তোকে করে দিতে হবে। তবেই ভূত মুক্ত করব কৃষ্ণনগর রাজ্য। আমার একশো ভূতের একবছরের খোরাক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে দিতে হবে। আমার ভূতেরা প্রতিমাসের খোরাক ওখানে গিয়েই নিয়ে আসবে। কথার খেলাপ হলে সবাই গিয়ে উৎপাত করবে। তখন বুঝবে কতধানে কত চাল।" গোপাল ভাঁড় ভূতের রাজার শর্তে রাজি হয়ে যায়। সেই সময় কৃষ্ণনগরকে ভূতের উৎপাতের হাত থেকে বাঁচানোয় তার মূল উদ্দেশ্য ও চিন্তা ছিল। এরপর পাঁচটি ভূতকে ধরার জন্য ভূতের রাজা গোপালকে পাঁচটি কাঁচের বোতল ও একটা ঝাঁটা দেন। তিনি বলেন --- "তোদের ওই রাজ্যে পাঁচটি ভূত এসমস্ত করছে। এই পাঁচটি বোতলে পাঁচজন ভূতকে ভরবি। ভুল করেও একটি বোতলে দুজন ভূতকে ভরবি না। তাহলে বোতল ফাটিয়ে ওরা দুজন বেড়িয়ে যাবে। আর ওদের কখনো বোতলে ধরতে পারবি না। প্রত্যেক ভূতকে বোতলে ভরার আগে বলবি-- "ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি/ তাড়াতাড়ি এই বোতলে আয়, তোদের বন্দী করে নিই।" এই মন্ত্র শুনে বোতলের মধ্যে না এলে বলবি-- 'ওং তিড়িং বিড়িং ছট, ভূতের মাথায় জট/ বোতলটিতে ঢুকে পর, ঝটপট ঝটপট।' এই মন্ত্র দুটো বললে ভূতেরা সবাই তোকে দেখা দেবে, অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারবে না। তোর হাতে ঝাঁটা দেখে ভয়তে মন্ত্রপাঠের পর বোতলে ঢুকে যাবে। বোতলে ঢোকার পর ঢাকনাটি খুব শক্ত করে আটকে দিবি। ভুল করেও বোতলের ঢাকনা যেন খোলা না থাকে। তাহলেই বিপদে পড়বি। একটা একটা করে বোতলে ভরে মুখ আটকাবি। ওরা চালাকি করতে পারে, সাবধান। আমি তোর শরীরকে মন্ত্রপুত করে দিচ্ছি,আর এই ছোট্ট হাড়টি হাতে বাঁধবি-- তবেই ওরা তোর কিছুই করতে পারবে না। ওদের ধরে কৃষ্ণনগরের উত্তর দিকে একটা বিরাট মাঠ আছে,সেই মাঠের মধ্যে একটা বৃহৎ বট গাছ আছে। ওই গাছের পাশে কুড়িহাত গর্ত খুঁড়ে কাঁচের বোতল গুলো রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিবি। আর ওই মাটিতে একটি ত্রিশূল পুঁতে লাল কাপড় দিয়ে গাছটির সঙ্গে বেঁধে দিবি। একযুগ পরে ওরা ভূতজন্ম থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। ওখানে যাওয়া চিরকালের জন্য মানা বলে সারা রাজ্যে ঢেরা পিটিয়ে দিবি।" এই কথাগুলো শুনে গোপাল ভাঁড় চিৎকার করে বলে ওঠে --- " জয় ভূতের রাজার জয়,জয় ভূতের রাজার জয়।" গোপালের সঙ্গে সকল ভূতেরাও একই ভাবে ভূতের রাজার জয়ধ্বনি দেয়। হঠাৎ গোপাল ভাঁড়ের ঘুম ভেঙে যায়। গোপাল খাটের উপর বসে ভাবে এটা যদি স্বপ্ন না হয়ে বাস্তব হতো তবে সত্যি সত্যি ভূত তাড়ানো যেত। আক্ষেপের সঙ্গে খাট থেকে নামার সময় গোপাল দেখে তার টেবিলের উপর পাঁচটি বোতল ও একটা ঝাঁটা রয়েছে। সে অবাক হয়ে যায়। বোতলগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা কাগজে স্বপ্নে দেখা মন্ত্রদুটি লেখা রয়েছে। পাশেই মানুষের হাড়ের একটি তাবিজ রয়েছে। এগুলো দেখে গোপাল বুঝতে পারে ভালোর জন্য কখনো কখনো স্বপ্নও সত্যি হয়। সে ভূত তাড়ানোর উপায় পেয়ে আনন্দের সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি যায়। রাজামশাই গোপালকে বলেন---" গোপাল কোনো বুদ্ধি বেরলো তোমার মাথা দিয়ে? এভাবে রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতি আর দেখা যাচ্ছে না। ভূতের রাজার কাছে তুমি যাবে বলছিলে। এ নিয়ে কিছু ভেবেছ তুমি?"এরপর গোপাল ভাঁড় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বলে---" ভূত তাড়ানোর পথ আমি পেয়ে গেছি রাজামশাই। সমগ্ৰ কৃষ্ণনগরে ঢেরা পিটিয়ে আজই বলে দিন আগামীকাল সারা দিনরাত্রি কেউ যেন বাড়ির বাইরে না বেরয়। কাল আমাদের ভূত তাড়ানোর দিন। ভূতের রাজার দেখানো পথেই আমরা কাল ভূত তাড়াব। আমি যখন ভূত বোতলে ভরব তখন আপনি মন্ত্রী ও সেনাপতিকে নিয়ে আমার থেকে একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমি কীভাবে তেনাদের ধরছি ও কোথায় কীভাবে রাখছি তা আপনি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখবেন। কাছে গেলে বিপদ আরও বাড়বে। আর আমায় একটা ত্রিশূল ও গোটা চারেক লাল গামছার ব্যবস্থা আপনি করে দেবেন। ভূত ধরার পর আমাদের কৃষ্ণনগরের উত্তরে যে বিশাল মাঠটি আছে সেখানকার সবচেয়ে বড় বটগাছের নিচে এই ভূত গুলোকে বন্দী করে রাখব। আপনি সারা রাজ্যে  বলে দেবেন কাল থেকে রাজ্যের উত্তর দিকে সকলের যাওয়া একেবারে বারণ। তাছাড়া আর একটা কথা, আপনার অনুমতি না নিয়ে রাজ্যের রক্ষার্থে আমি ভূতের রাজার একটি শর্ত মেনে নিয়েছি। ওদের সমস্ত ভূতের এক বছরের খাবার আমাদের দিতে হবে, নতুবা ওরা সকলে এসে এ রাজ্যে উৎপাত চালাবে।" গোপালের কথা শুনে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বলেন --- "ঠিক আছে গোপাল তুমি যা যা বললে সেই মতই সব হবে। ভূতের রাজার ভূতেদের একবছরের খাবারও দেব। আমি এখনি সারা রাজ্যে ঢেরা পিটিয়ে সব বলে দিচ্ছি। তবে ভূত ধরার কাজটা খুব সাবধানে করো। আমি তোমার সঙ্গে আছি।"
     পরদিন সন্ধ্যাবেলা গোপাল ভাঁড় ভূতের রাজার দেখানো পথেই একটার পর একটা ভূত বোতলে ভরে। মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করার পর গোপালের সামনে সবকটি প্রকট হয়। সাহসের সহিত গোপাল তাদের বোতলে ঢুকতে বলে। তারাও কোনো কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে বোতলে ঢুকে যায়। গোপালের হাতে ঝাঁটা দেখে তারা টুশব্দটি করে না। তারপর গোপাল বোতলগুলোর মুখ ভালো করে আটকে উত্তরের সেই বিশাল মাঠের মধ্যিখানে থাকা বিরাট বটগাছের নিচে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেয়। একটা বড় ত্রিশূল সেই মাটির উপর পুঁতে লাল গামছা দিয়ে বটগাছের সঙ্গে ত্রিশূলটি ভালোভাবে বেঁধে দেয়। এভাবেই গোপাল ভাঁড় ভূতের রাজার দেখানো পথে কৃষ্ণনগর রাজ্যকে ভূতেদের উৎপাত থেকে চিরতরে রক্ষা করেছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গোপালকে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা ও পাঁচ বিঘা জমি দান করেছিলেন। সারা রাজ্যে গোপাল ভাঁড়ের নামে ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিল।
_____________________________________________________________________________________



মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা
পিন -- ৭৪৩২৫২
 
 
 
 
[চিত্রঃ: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]

মন্তব্যসমূহ

সপ্তাহের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

কবিতা ।। আকাশ-সাগর ।। শান্তনু আচার্য

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

কবিতা ।। নতুন বছর ।। জীবন সরখেল

চোখের ভাষা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত

ছড়া ।। শীতের দু'টি মাসে ।। গোবিন্দ মোদক

প্রচ্ছদ ও সূচীপত্র ।। 24th issue: September 2023

ছোটদের আঁকিবুঁকি ।। কিশলয় - ২২ ।। জুলাই ২০২৩

ছড়া ।। দৃষ্টিকাড়া বৃষ্টি ।। শচীন্দ্র নাথ গাইন

ছড়া ।। অদ্ভূতুড়ে ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

মাসের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

কবিতা ।। আকাশ-সাগর ।। শান্তনু আচার্য

ছড়া ।। শৈশবের রথ ।। ইয়াসমিন বানু

কবিতা ।। নতুন বছর ।। জীবন সরখেল

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

অণুগল্প ।। ঝুমুক ঝুমুক ।। ব্রজ গোপাল চ্যাটার্জি

ছোটগল্প ।। হেমন্ত দাদার সাথে ।। দীপক পাল

ছড়া ।। আকাশটাকে খোঁজে ।। দীনেশ সরকার

ছড়া ।। শীতবুড়িটা ।। প্রবোধ কুমার মৃধা

কবিতা ।। খুকির বায়না ।। খগেশ্বর দেব দাস

বছরের পছন্দ

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। ত্রয়োত্রিংশ সংখ্যা ।। জুন ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 38th issue: January 2025

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সুচিপত্র ।। 37th issue: December 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। চতুর্ত্রিংশ সংখ্যা ।। জুলাই ২০২৪

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচীপত্র ।। 29th Issue: February

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 31st issue: April 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 32nd issue: May 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 30th issue : March 2024

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। পঞ্চত্রিংশ সংখ্যা ।। আগষ্ট ২০২৪

অতি প্রিয়

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। আত্মপ্রকাশ সংখ্যা ।। অক্টোবর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। দ্বিতীয় সংখ্যা ।। নভেম্বর ২০২১

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 4th issue: January 2022,

নিবন্ধ ।। শিশু-কিশোর সাহিত্যবলয়ে শিশুরাই যেন ব্রাত‍্য না থাকে ।। অরবিন্দ পুরকাইত

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। 7th issue: April 2022

নিবন্ধ ।। দেশীয় উদ্ভিদ কেন গুরুত্বপূর্ণ ? ।। ডঃ চিত্তরঞ্জন দাস

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১০ ।। জুলাই ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১১ ।। আগস্ট ২০২২

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র : 8th issue: May 2022

প্রচ্ছদ, সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র ।। কিশলয় - ১২ ।। সেপ্টেম্বর ২০২২