টাইম টেমিং
কার্তিক চন্দ্র পাল
মার্চ মাসের সকাল। ড্যানিয়েল আর আমি ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ফিকাস ক্যাফেতে বসে চিজস্টিক খেয়ে এক কাপ কফি নিলাম। প্রিন্সটনে আবহাওয়া এখন বেশ মনোরম। অন্তত তীব্র ঠান্ডাটা আর নেই। আজ মেজাজটা বেশ ফুরফুরে ছিল। ড্যানিয়েল কে বললাম কার্নেগি লেকে আজ একটু বেড়িয়ে আসি। মেপলটন রোড হয়ে ওয়াশিংটন ব্রিজে পৌঁছতে ছয় মিনিট লাগলো। লেকে গিয়ে ম্যাপল গাছের তলায় বসলাম দুজনে। গতকালও বেশ রাত জেগে কাজ করতে হয়েছে। পরপর তিনরাত ঘুমানো যায়নি। বেরোনোর আগে তাই এটুনিম নিয়ে নিলাম। প্রথমদিকে আমার আবিষ্কৃত এই ওষুধটি নিষিদ্ধ ড্রাগ ভেবে নিয়েছিল সকলে। তাই এটুনিমের উপর প্রথমে প্রিন্সটন অ্যালকোহল অ্যান্ড ড্রাগ অ্যালায়েন্সের (PADA) এর কড়া নজরদারি ছিল। এখন অবশ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন চমৎকার এই ওষুধ WHO এর স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। জন্মসূত্রে আমি ভারতীয়। তাই প্রিন্সটনে ওষুধটির ছাড়পত্র জোগাড় করতে বেশ বেগ পেয়েছিলাম। সাইন্যাপসের উপর এটা কাজ করে। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে।
ড্যানিয়েল এর সাথে টাইম ডাইলেশন নিয়ে আমাদের গবেষণাপত্রের বিষয়ে কথা হচ্ছিল। আমার নতুন আবিষ্কারের কথা ওকে কিছু বললাম না। আজ প্রায় একমাস হলো পৃথিবীর সময়টা বদলে গেছে। এখন ৩০ ঘন্টায় দিন। পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পড়ে গেছে। পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমাগত কমে আসছে। মেরু প্রদেশের গলে যাওয়া বরফ গুলো আবার জমতে শুরু করেছে। এখন মনে হচ্ছে আমরা যেন আবার ২০০০ সালের পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। ড্যানিয়েলও আজ সে কথাই বলল। ১০০০ বছর আগে পৃথিবীটা আমরা তেমনি দেখেছিলাম।
হ্যাঁ, আমাদের বয়স হাজারের বেশি। আমার বয়স ১০৫৮ বছর আর ড্যানিয়েল এর বয়স ১০৫০ বছর।
অব্রে ডে গ্রে এর ভাবনা নিয়ে আমি ২০৫০ সাল নাগাদ শরীরে বার্ধক্যকে আটকে দিয়ে ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকার ঔষধ টিথোনাসিন আবিষ্কার করেছিলাম। ড্যানিয়েল আর আমি এই দুজনমাত্র এই ওষুধ টা সম্বন্ধে জানি যা আমরা নিজেদের শরীরে প্রয়োগ করেছি।
অবশ্য তার আগে ড্যানিয়েলের শরীরে ভেরিটাসিন ইঞ্জেক্ট করে দিয়েছিলাম। এটা মানুষকে সত্যবাদী আর ভালোবাসাপ্রবণ করে তোলে। ভেরিটাসিন কোন নিউরোট্রান্সমিটার ড্রাগ নয়, এটা একটা জেনেটিক ড্রাগ। তাই নিশ্চিন্ত। এটা আবার অক্সিটোসিনের মাত্রাও সঠিক রাখে। সুতরাং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। সব দেশেরই রাজনৈতিক নেতারা ভেরিটাসিনের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বস্তুত সকলেই মিথ্যার ব্যাপারী। সত্যের অনুপ্রবেশ সেখানে বিপজ্জনক। খুব গোপনে এক ফাইল মাত্র ব্যবহার করা গেছে। কিন্তু তবু তাকে সময়ের ব্যাপার টা বলা যাবে না। আমিই যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি কমিয়ে দিয়েছি এটা আমার মধ্যেই থাক। একটি গ্রহকে ছোটো করে পৃথিবীতে রেখেছি কেবল ওজন বাড়ানোর জন্য।
গ্রহকে ছোট করা একটা দুষ্কর কাজ ছিল। কারণ এটা করতে গিয়ে আমাকে গ্রহের সকল পদার্থের পরমাণুর ইলেকট্রন গুলোকে সরিয়ে দিতে হয়েছে। কেবল নিউক্লিয়ন গুলোকে একটি বাক্সে ছোট গোলকের মতো কম্প্রেস করে এনেছে আমার তৈরি যন্ত্র স্কাই স্ক্যাভেঞ্জার।
তারপর সেটাকে পৃথিবীর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর ওজন এখন আগের ওজনের প্রায় দেড় গুণ। ওজন বেড়ে যাওয়ায় আহ্নিক গতি গিয়েছে কমে। তাই এখন অফুরন্ত সময়। সময়ের উপর এই খোদকারি নিতান্তই এক মাসের জন্য। পৃথিবীর উষ্ণতা যে হারে বেড়ে গিয়েছিল তাতে আর কিছু কালের মধ্যে এই গ্রহ মানুষের বাসযোগ্য থাকতো না।
গত তিনদিনে নিউক্লিয়নে আবার ইলেকট্রনের পরত ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সম্ভবপর হয়েছে। তাই আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই পৃথিবীর উষ্ণতা স্বাভাবিকে নেমে এলে গ্রহটিকে তার আগের জায়গায় ফিরে রেখে আসবো।
তারপর আপাতত কাজ শেষ। তাই সফলতার এই দিনে আমার হাজার বছরের সঙ্গী ড্যানিয়েল এর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু ড্যানিয়েল হঠাৎ আমায় বলল : "গ্রহটা কি আমাদের পৃথিবীতে থাকবে?"
শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমি কোন গোপন গবেষণা করলে ড্যানিয়েল তার ধারে পাশে থাকে না কোনদিন। বিশ্বাসযোগ্যতায় কোনদিন চিড় ধরেনি। তাহলে ভেরাটোসিনের প্রভাব কি শেষ হতে চলেছে?
জিজ্ঞেস করলাম কোন গ্রহ?
জিজ্ঞেস করতে সে সব সত্য কথা গরগর করে বলে দিল। না ভেরাটোসিনের প্রভাব পুরোপুরি কাটেনি। মিথ্যা সে বলতে পারে না।
কিন্তু ড্যানিয়েল -এর কথায় ভয় পেয়ে গেলাম। সে লোভী হয়ে উঠেছে। পার্থিব বস্তুর। এর আগে যেটা ওর মধ্যে দেখিনি। আমাকে সে বলল যে গবেষণার বিষয় সে জানে। তাই শুধু না। আমার আবিষ্কারের অনেক ওষুধ সে পেটেন্ট-এর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে।
যেটা ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হল, আমাকে চমকে দিল। তবে কি খোদার উপর খোদকারি চলে না? আমি স্থির থাকতে পারলাম না, পৃথিবীর সমূহ বিপদের কথা ভেবে আমি দর দর করে ঘামতে লাগলাম।
নাহ্ আর অপেক্ষা নয়। বাড়ি ফিরেই তাই স্কাই স্ক্যাভেঞ্জার কে পাঠিয়ে দিলাম। গ্রহটিকে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আনিয়ে তার পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে শীঘ্রই।
এক সপ্তাহ পর। ড্যানিয়েল কে নিয়ে আবার ফিকাস ক্যাফেতে বসলাম আজ। ঈশ্বরের সৃষ্টির উপর কলম চালানোর চেষ্টা আর নয়। ড্যানিয়েল আর আমি দুজনেই আজ বিদায় নিচ্ছি পৃথিবী থেকে। ড্যানিয়েল সেটা জানেনা। সময়কে হাজার বছর থামিয়ে রেখেছিলাম। আজ থেকে তা প্রাকৃতিক নিয়মেই চলবে। শুধু উষ্ণ পৃথিবীটা আবার বাসযোগ্য করে গেলাম। আর আমার এই গোপন ই-ডায়েরিটি ক্যাফের টেবিলের উপর রেখে যাচ্ছি।
বিষ মেশানো কফি-কাপ আমাদের শেষ চুমুকের অপেক্ষায় রয়েছে।
__________________________________________
কার্তিক চন্দ্র পাল
বর্ধমান।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন