সময়ের সিঁড়ি
অর্পিতা মল্লিক
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ রোহনের । ওর বাবা পেশায় বিজ্ঞানী ছিলেন কিন্তু উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যর জেরে সেখানকার চাকরি ছেড়ে নিজের
বাড়িতেই ল্যাবরেটরি বানিয়ে ছোট খাটো গবেষণা করেন।
ছোটবেলা থেকেই রোহনের অদম্য কৌতুহল।
প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ও জানতে চায়। বাবার হাজার বারণ সত্বেও একদিন বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে করতে অদ্ভুত একটা ঘড়ির মতো যন্ত্র দেখে চোখ আটকে গেল।সেটার গায়ে লেখা ছিল
" Chrono -step 1.0' ও তার নীচে ছোট করে লেখা --
"সময় শুধু ঘড়ির কাঁটায় নয় , পায়ের নীচেও সিঁড়ি হতে পারে '।
নবম শ্রেণির ছাত্র হওয়ায় কাইনেম্যাটিক্স (গতিবিদ্যা ) পড়া থাকার সুবাদে যন্ত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা চাকতির মতো একটা হ্যান্ডেল ঘুরাতেই চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল। চোখ খুলতেই রোহন নিজেকে খুঁজে পেল ১৯৫০ এর কলকাতায় । রাস্তায় গাড়ির বদলে ঘোড়ায় টানা ফিটনগাড়ি চলছে। মানুষের পোষাক -আশাক , চারপাশের পারিপার্শ্বিক সবই ছিল অন্যরকম।
ও বুঝলো ,যন্ত্রটা সময় ভ্রমণের ।সে ওই সময়ের কিশোরদের সঙ্গে মিশে গেল। ওদের সাথে পাঠশালায় গেল।এক বন্ধুকে পড়া বোঝায় সাহায্য করলো। এক বৃদ্ধলোককে রাস্তা পার করে দিল । কিছু সময় পর ও বুঝতে পারল ওর বর্তমান সময়ে ফিরে যাওয়া দরকার।
শেষ মুহূর্তে সে একটা চিঠি লিখে এলো , ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে হাঁটো, কিন্তু অতীতের মানুষগুলোকে ভালবাসতো ভুলে যেও না '।
বর্তমান সময়ে ফিরে এসে সে বুঝতে পারলো " সময় ভ্রমণ ' তার মধ্যে এক নতুন চোখ খুলে দিয়েছে। সে এখন শুধু বিজ্ঞান নয় , ইতিহাস ও ভালবাসতে শিখেছে।
রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেই ও বাবার কাছে টাইম ট্রাভেল মেশিন নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো স্বভাবচিত ভঙ্গিতে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বাবাকে বুঝতে দিল না যে ও টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ঘুরে এসেছে।
কিছু দিন পর আবার একদিন রোহন বাবার ল্যাবরেটরিতে গেল। এবার ও ঐ chrono -step যন্ত্রটার আগের দিন হ্যান্ডেলটা যেদিকে ঘুরিয়েছিল তার উল্টো দিকে ঘুরালো। চট করে একটা বিদ্যুত খেলে গেল । শরীরটা হালকা হয়ে এলো।চোখ খুলতেই এক আশ্চর্য জগতে নিজেকে পেল।
কলকাতা শহর এখন আকাশে ভাসমান , রাস্তা স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি, গাড়িগুলো উড়ছে আর মানুষেরা হেলো স্ক্রীনে কথা বলছে ।
চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। প্রাচুর্যের কোনো অভাব না থাকলেও কারো আনন্দ নেই, দুঃখও নেই। অনুভূতি হীন।
রোহন বুঝতে পারলো ও ৩০৫০ এ এসে গেছে টাইম ট্রাভেল করে। কাঁচের রাস্তায় চলতে প্রথমে ভয় লাগলেও একটু পরে ও বুঝলো ঐ কাঁচ আনব্রেকেবল--সহজে ভাঙ্গবে না তাই স্বচ্ছন্দে হাঁটতে হাঁটতে ওর বয়সী একটা মেয়েকে দেখতে পেল । মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে ওর নাম "আয়রা 'জানতে পারল।আয়রা জানাল , এখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এতো দূরত্ব তৈরি করেছে ,যে গাছপালা প্রায় বিলুপ্ত , পশুপাখি শুধু ভার্চুয়াল জগতে দেখা যায়।
রোহন জিজ্ঞেস করে ,"তোমরা কি খুশি ?'
আয়রা একটুও হাসলো না --
: আমরা জানি না খুশী কাকে বলে ? আমাদের আবেগ গুলোও এখন আ্যপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ; ।
রোহন আরো জানল , মানুষ এখন নিজ হাতে কিছুই তৈরী করে না -- সব কিছু করে রোবট। কিন্তু সেই সঙ্গে মানবিকতা , কল্পনা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাও হারিয়ে যাচ্ছে ।
আয়রা রোহনকে একটা গোপন "গ্ৰীন ক্লাবে' নিয়ে গেল অন্ধকার হলে । সেখানে কিছু শিশু গোপনে মাটি খুঁড়ে একটি চারাগাছ লাগাচ্ছিল।
আয়রা
ফিসফিসিয়ে বললো, "আমরা এখন হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।'
রোহন তাদের সঙ্গে একটা বীজ পুঁতে দিয়ে বললো,--:ভবিষ্যত যদি বাঁচাতে চাও তবে , আজকেই একটা বীজ বপন করো -- মনে ,মাটিতে আর মনুষত্বে '।
এমন সময়ে টাইম ট্রাভেল মেশিনের আ্যলার্ম ক্লকে সেট করা সময় হয়ে যাওয়ায় ঘড়ি টিকটক শব্দ করে উঠলো।রোহন ফিরে এলো বর্তমান সময়ে। তার হাতে ছিল এক ছোট পাত্রে
একটা অদ্ভুত গোলাকার বীজ---হয়তো ভবিষ্যতের সেই গাছের বীজ।
রোহন ঠিক করল ,সে তার স্কুলের পাশে একটা বাগান তৈরী করবে---" ভবিষ্যতের বীজ ' নামে ।
_____________________________________________
অর্পিতা মল্লিক
৪৬৮ ড্রিম পার্ক , ব্লক -B1,
ফ্ল্যাট -1A, সোনারপুর
স্টেশন রোড ,
কলকাতা - ৭০০১০৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন