জয় বাবা মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছে আন্দামান। কাকাই বিতানও এসেছেন সঙ্গে। পোর্টব্লেয়ারে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ল্যান্ড করতেই উত্তেজনায় জয়ের বুকের ভেতর আনন্দের হাওয়া বয়ে গেল। এয়ারপোর্টে হোটেলের প্ল্যাকার্ড হাতে একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে গাড়ি করে জয়, কাকাই, বাবা সুমনবাবু আর মা মিতা দেবী হোটেলের দিকে চললেন।
রাস্তা এখানে খুব সুন্দর করে সাজানো। দুপাশে অনেক গাছপালা। একটু দূরে সমুদ্রের আওয়াজ। চোখ জুড়িয়ে যায়। বর্তমানে আধুনিক দোকান বাজার হয়েছে পোর্টব্লেয়ার জুড়ে। দ্বীপ রাজ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া। হোটেলও আধুনিক ব্যবস্থা দেখে ভালোই লাগে জয়ের। সামান্য ফ্রেশ হয়ে আবারও গাড়ি করে পোর্টব্লেয়ার শহরটা ঘুরে সেলুলার জেল দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল।
সেলুলার জেলের ছাদ থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে জয়ের একটা বিষয় খটকা লাগল। দূরে সমুদ্রের ধারে মনে হল একটি ছেলেকে কয়েকজন মিলে একটা ঝোপের ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
জয় তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল। মা বাবা একটা বেঞ্চে বসে আছেন। কাকাই ক্যামেরায় ছবি তুলছে। ও বলল, আমি একটু সমুদ্রের ধারে আছি। মা বললেন, বিকেলের টিফিন আর চা খেয়ে আমরা সন্ধ্যার লাইট এন্ড শো দেখে হোটেলে ফিরব।
জয় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে সমুদ্রের ধারে সেই ঝোপের কাছে গিয়ে কিছু বা কাউকে দেখতে পেল না। এদিকে ওদিকে নজর করে একটা রুমাল পড়ে থাকতে দেখল। অন্যের ব্যবহার করা রুমাল ধরতে একটু অস্বস্তি হলেও জয় পকেট থেকে টিসু পেপার বার করে রুমালটা তুলে সাইড ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। একটু দূরে একটা বাহারি সানগ্লাস পড়ে রয়েছে। জয় সেটাও ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। এদিকে লোকজন কম, কেউ দেখছে বলে মনে হল না। যার জিনিস সে খোঁজ করলে দিয়ে দেবে।
মা বাবা, কাকাই এর সাথে একটা রোড সাইড ক্যাফেতে ওরা বিকেলের টিফিন আর চা খেল। তারপর লাইট এন্ড সাউন্ড এর জায়গায় ঢোকার লাইনে দাঁড়াতেই মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা গেল, অরুণ রায় তুমি যেখানেই থাকো টিকিট ঘরের সামনে চলে এস। তোমার মা বাবা এখানে অপেক্ষা করছেন।
টিকিট ঘরের সামনে এক দম্পতি পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। নিশ্চয়ই অরুণের বাবা মা। জয় দৌড়ে তাদের সামনে চলে গেল। সুমনবাবু আর মিতাদেবী অবাক হয়ে জয়ের পেছনে।
জয় ব্যাগ থেকে রুমাল আর সানগ্লাস বের করে বলল, আচ্ছা কাকু দেখুন তো এগুলো কি অরুণের?
অরুণের মা সীমাদেবী কেঁদে ফেললেন। এগুলো তো অরুর। তুমি এগুলো কোথায় পেলে?
জয় কিভাবে ওগুলো পেয়েছে বলতেই পুলিশ অবাক আর অরুণের বাবা বিকাশবাবু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
পুলিশ অফিসার মিঃ সিং বললেন, তুমি শো দেখে নাও। আন্দামানে অপরাধী পুলিশকে ফাঁকি দিতে পারে না।
জয় বলল, কাকু অরুণের খোঁজ পাওয়া গেল কিনা একটু জানাবেন প্লিজ।
পুলিশ আর বিকাশবাবু জয়ের ফোন নং নিয়ে নিলেন।
শো শেষ হলে অন্য পুলিশদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল অরুণের এখনও কোনও সন্ধান পাওয়া যায় নি। মনে চিন্তা নিয়ে ওরা হোটেল ফিরলেন। আগামীকাল ওদের হ্যাভলক দ্বীপে যাবার কথা। মা বললেন, বিতান জয়ের খেয়াল রেখো। আন্দামানে চোর ডাকাত নেই বলেই জানতাম। কিডন্যাপার আছে জানতাম না।
পরদিন ভোরে লঞ্চ। সেখানেই ব্রেকফাস্ট। লঞ্চে পর্যটকরা তো যাচ্ছেন, কিছু লোকাল লোকজনও যাচ্ছে। বড় একটা প্যাকিং বাক্সও লঞ্চে উঠল। লঞ্চের খালাসিদের একজন আপত্তি করছিল, অন্য একজন বলল ছেড়ে দে ওরা তিনগুণ ভাড়া দিয়েছে।
লঞ্চ ছেড়ে দিল, সমুদ্রের অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে জয় গতকালের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
বাক্সটা ডেকের ওপর পড়েছিল। দুজন গুন্ডা মত লোক মাঝে মধ্যেই বাক্সটাকে দেখে যাচ্ছিল। জয়ের কেমন যেন সন্দেহ হল।আবারও আনমনে দূরের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের শোভা দেখছিল জয়। কাকাইও জয়ের পাশে পাশে।
হ্যাভলকে পৌঁছে সবাই মেতে উঠল স্মরকেলিং আর স্কুবা ডাইভিং এর জন্য। প্রত্যেকে একজন করে নুলিয়া নিয়ে সমুদ্রে নেমে পড়ল।সমুদ্রের নীচে বিভিন্ন সুন্দর কোরাল দেখে সবাই আনন্দে আত্মহারা।
বাক্সটা নামিয়ে সেই গুন্ডা মত লোকগুলো একটা গাড়ি ডেকে বাক্সটা তুলে নিয়ে গেল। জয় বলল, কাকাই দেখো, বাক্সটা যেন বড্ড ভারি। লোকগুলোর বেশ কষ্ট হচ্ছিল গাড়িতে তুলতে।
কাকাই বলল, ঠিক বলেছিস। আজ আমাদের এখানেই রাতে থাকা। আর ছোট্ট দ্বীপ, তাই আবার ওদের দেখা পেতে পারি।
বিকেলে মা বাবা হোটেলের লনে চেয়ারে বসে রইলেন। জয় আর কাকাই এদিকে ওদিকে হাঁটতে বেরলো।
হোটেলের পাশে একটা পুরোনো বাগানবাড়ি আছে। বাড়ি পুরোনো কিন্তু বাগানে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে।
জয় বলল, কাকাই সেই গাড়িটা মনে হচ্ছে।
বিতান বলল, ঠিক বলেছিস। আচ্ছা, অরুণকে পাওয়া গেল কিনা খোঁজ নিই। পুলিশের কাছেই ফোন করি।
ফোন করতেই পুলিশ অফিসার বললেন, এখনও কোনও ট্রেশ পাইনি। ওরা মনে হচ্ছে পোর্টব্লেয়ার ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
আচ্ছা বলে কাকাই ফোন রেখে দিল। বলল, চল ওই বাড়ির পেছনে সমুদ্রের ধারে একটু পায়চারি করে আসি। বলতে বলতেই একটা আর্ত চিৎকারে ওরা দুজনে চমকে উঠলো। একটা ছেলের কান্না।
ওরা দ্রুতগতিতে গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
একটা জোরালো ধমকের আওয়াজ আর কান্নার শব্দ। দুজনে পা টিপে টিপে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। একটা জানালার পাল্লা ভাঙা সেই ফাঁকে চোখ রেখে জয় উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যেতেই কাকাই ওর মুখ চেপে ধরলো।
আবার পা টিপে টিপে সমুদ্রের ধারে এসে কাকাই আবার পুলিশ অফিসারকে ফোন করে হ্যাভলকের বাগানবাড়িতে কি দেখতে পাওয়া গেছে তাই বলল।
পুলিশ অফিসার মিঃ সিং বললেন, আমি এখুনি ওখানকার পুলিশকে ফোর্স নিয়ে যেতে বলছি। আপনারা সাবধানে লুকিয়ে থাকবেন।
আরও আধাঘন্টা পরে পুলিশের গাড়ি থামল বাগানবাড়ির গেটে। জয় আর বিতান এগিয়ে এলো। জয় বলল, ওই ঘরে একটি ছেলেকে আটকে রেখেছে। ওকে মারধোরও করছে।
অফিসারের ঈঙ্গিতে গোটা দশেক বন্দুক ধারী পুলিশ বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে অফিসার বললেন, দরজা খোলো। ভেতর থেকে আওয়াজ শোনা গেল, কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে এই ছেলেটাকে মেরে ফেলবো।
অফিসার থমকে দাঁড়ালেন। জয় দুজন পুলিশের সঙ্গে পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
পেছনের দরজাটা ভাঙা। তাই আটকানো নেই। জয় সেই ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। গুন্ডা দুজন সামনের দরজায় এদিকে পেছনের ঘরে একটি ছেলেকে বেঁধে রাখা আছে। কাকাইও এসে গেছে। দুজন মিলে ওর বাঁধন খুলে দিল। কজন পুলিশও ঢুকে এসেছেন। সবাই মিলে ছেলেটিকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে এল।
সামনের দরজা পুলিশ ভেঙে দিল। লোকদুটি ভালোই মারামারি করল। ভাগ্য ভালো ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। ওরা শেষমেষ পুলিশের হাতে ধরা পড়ল।
অরুণ জয়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলল। জয় বলল, তোমার মা বাবার সঙ্গে কথা বলবে ফোনে? অরুণ মাথা নাড়লো।
তারপর ফোনে কেঁদে ফেলল। বলল, বাবা ওরা তোমার কাছে কি একটা ফর্মূলা চাইছিল। তাই আমাকে আটকে রেখেছিল।
অফিসার বললেন, কালই তোমাকে তোমার বাবা মার কাছে নিয়ে যাবো।
জয় বলল, আজ কি অরুণ আমাদের কাছে থাকতে পারে স্যর? কাল আমরা সবাই পোর্টব্লেয়ারে ফিরব।
অফিসার বললেন, ঠিক আছে। আমরা পাহারায় থাকব। চিন্তা নেই।
পরদিন পোর্টব্লেয়ারে অরুণের বাবা মা মিঃ সিং সবাই অপেক্ষা করছিলেন। অরুণ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
বাবা বললেন, বিকাশবাবু আমি কিন্তু এবার আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিকাশ রঞ্জন।
বিকাশবাবু বললেন, আর ওই বিজ্ঞানের একটা ফর্মূলা পাওয়ার জন্য খারাপ লোকেরা আমাকে হুমকি দিচ্ছে। ওরা এটাকে নিয়ে ব্যবসা করবে আর আমি চাই দেশের মানুষের সেবায় লাগুক আমার এই আবিস্কার। এবার তো আমার অরুকেও ওরা কষ্ট দিল। পুলিশ প্রোটেকশনে এবার সরকারের কাছে জমা করে দিয়ে আমার শান্তি।
বাবা, মা, কাকাই, পুলিশ অফিসার একসাথে বললেন, আপনার সাধু ইচ্ছেরই জয় হবে, চিন্তা করবেন না। পুলিশ সবসময় আপনার প্রোটেকশন দেবে।
তবে জয় আর তার কাকাই বিতানের কৃতিত্ব অরুণের উদ্ধারের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ওরা উদ্যোগ নিয়েছে বলেই আমরা অরুণকে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলাম।
অরুণের মুখে হাসি, বলছে জয়দাদা আর কাকাই ব্রেভ।
মিঃ সিং বললেন, ঠিক এজন্যই আন্দামান পুলিশ ওদের দুজনকে সম্বর্ধনা দেবে। এটা প্রেসিডেন্টের নির্দেশ।
সবার মুখে স্বস্তির হাসি।
___________________________________________
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন