মাস্টার দা
মিঠুন মুখার্জী
আজ যার কথা লিখতে যাচ্ছি তিনি ছোট্ট চারা থেকে আজ বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছেন। যার ছত্রছায়ায় অসংখ্য মানুষ এগিয়ে চলেছে তাদের লক্ষ্যের দিকে। মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। অভাবী জীবনকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছেন। তাই আজ অভাবী মানুষদের পাশে তিনি একজন অভিভাবক হয়ে দাঁড়ান । আমার মাস্টারমশাই। বর্তমানে ডক্টর দীপঙ্কর মল্লিক নামে তিনি পরিচিত। এগিয়ে যাওয়ার জন্য লড়াই কিভাবে দিতে হয় এই মানুষটির কাছ থেকে শিখতে হবে। আমি প্রতিটি মুহূর্তে অনুপ্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর সম্পর্কে যে কথাই বলি না কেন অনেক কম বলা হয়।
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার স্বরূপনগর ব্লকের চারঘাটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই লড়াই করার মানসিকতা ছিল প্রবল। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে নাম-যশ-খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করবেন। জীবনে মানুষের প্রয়োজনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করবেন তিনি। তবে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেবেন না। মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। যতটুকু পারবেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। বাবা চাষবাস করে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন তাঁদের। বি. এ, এম. এ, বি.এড, পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন তিনি। আজ সেই ছোট্ট মাস্টারদা হয়েছেন ডক্টর দীপঙ্কর মল্লিক। রামকৃষ্ণ মিশন- এর বাংলার অধ্যাপক ও ডিপার্টমেন্টাল হেড। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছেন মসলন্দপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র কন্যা দেবারতী ম্যাডামকে। দুজনে যেন এক প্রাণ এক আত্মা। মাস্টারদা বলেন --- " জীব সেবায় শিব সন্তুষ্ট হন।" সুদীর্ঘ পঞ্চাশটি বসন্তে অনেক সফলতা অর্জন করেছেন তিনি কিন্তু একটুকুও অহংকার নেই। মানুষ বিপদে আছে দেখলে তিনি সহ্য করতে পারেন না। প্রচন্ড লড়াই দিয়েছেন তাঁর এই পঞ্চাশের জীবনে। চলার পথ খুব সহজ ছিল না। প্রতিকূলতাকে বিচক্ষণতা ও মেধার দ্বারা জয় করেছেন। নিজের জীবনে অভাব অনুভব করেছেন, তাই অভাবী মানুষদের পাশে থাকতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন।
মহামারী পৃথিবীর বুকে অনেকবার এসেছে কিন্তু সমগ্র বিশ্বজুড়ে মহামারি এবার বোধহয় প্রথম। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যখন মানুষের মৃত্যু মিছিল, তখন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সঙ্গীদের নিয়ে গিয়েছিলেন দুস্থ, অসহায়, অভাবী মানুষের কাছে। মানুষেরা জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন, অর্থের সংকটে খাওয়া জোটেনি। অসংখ্য মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন আমার মাস্টারদা। মাস্টারদার সঙ্গে ছিলেন উনার কিছু শিক্ষক বন্ধু ও সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীরা। তাপস পাল, পুষ্পেন্দু মজুমদার, সোমালি চক্রবর্তী, অস্মিতা মিত্র ও তপন বিশ্বাস ইত্যাদি শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীরা। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে "দ্যা গৌরী কালচারাল এন্ড এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশন" নামক একটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেজিস্ট্রেশন যুক্ত সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে বহু ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারন মানুষদের আশ্রয়দান করেছেন তিনি। নিজের জন্য নয়, অন্যের সেবার জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পেতেছেন। এর জন্য লজ্জা পান নি।
এরকম সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ খুব একটা চোখে পড়ে না। আমি তখন বি.এ দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা অনার্সের ছাত্র। মাস্টারদার কাছে পড়ি। কখনো মসলন্দপুর, কখনো হৃদয়পুরের নিবেদিতা পার্কে। 'আশীর্বাদ নাট্য সংস্থা' নামে একটি নাট্যদল গড়ে ছিলেন তিনি। মাস্টারদার বাড়িতে রিহার্সাল হতো। অভিনয় শেখাতেন তিনি নিজে। তাছাড়া শংকর দা নামে একজন সিরিয়াল অভিনেতা আসতেন অভিনয় শেখাতে। আমরা পাঁচ-ছয় জন ছেলে-মেয়ে খুব একটিভ ছিলাম। আমি, হীরক, প্রবীর, বিশ্বজিৎ, তিথি ও রুমা। সেই সকল দিনের কথা এখনো কোনো নিভৃত ক্ষণে মনের মনিকোঠায় ভেসে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে সকলেই অনেক পাল্টে গেছে কিন্তু পাল্টায়নি মাস্টারদার পথ চলা। তিনি এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাঁর সাধের সংস্থা গৌরীকে। হয়তো নাট্যদলটি নেই, কিন্তু মাস্টারদা যুক্ত হয়েছেন অনেক নাট্যদলের সঙ্গে। সংগীত, নাটক নিয়ে গবেষণামূলক কাজ কর্ম করেন তিনি। এখনও প্রায় আমার মনে পড়ে কালী পূজার সময় বারাসাতের বিভিন্ন জায়গায় নাটক করার দিনগুলির কথা। অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরা সেইসকল সুন্দর দিনগুলির কথা। যা যায় তা আর ফিরে না। আমি জানি সেই সকল দিন আর ফিরে আসবে না, কিন্তু এখন মনে হয় সেই সমস্ত দিনগুলি খুব সুন্দর ছিল। যতই বলি 'যেতে নাহি দিব' তবু যেতে দিতে হয়। সকলের ঊর্ধ্বে সময় কথা বলে।
মনে পড়ে যায় প্রত্যেক মাসের শেষ রবিবারের সাহিত্যের বাসরের দিনগুলির কথা। যেখানে বয়সের কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। সব বয়সের ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করতেন। নাচ-গান-আবৃত্তি- বক্তৃতা আরো বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত হত। সেদিন যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন প্রত্যেকের জন্যই মাঝে মাঝে মাস্টারদা টিফিন- এর ব্যবস্থা করতেন। তিনি অভিভাবক হয়ে অনুভব করতেন, দূর থেকে এসেছে সকলে, কেউ হয়তো না খেয়ে এসেছে আবার কেউ অনেকক্ষণ এসেছে, তাই সকলের জন্য সাধ্যমত টিফিনের ব্যবস্থা করতেন। মা যেমন সন্তানদের আগলে রাখেন মাস্টারদা ছাত্র-ছাত্রীদের সেইভাবেই নজর রাখতেন।
তাছাড়া গরিব মানুষের পাশে মাস্টারদা কিভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন তা যতই বলা হোক না কেন কম হবে। চারঘাট, পূবালী, মসলন্দপুর আরো বিভিন্ন জায়গায় আমাদের দ্বারা সার্ভে করে যাদের প্রকৃতই দরকার তাদের সারা বছরের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে নিতেন। বই-খাতা-পেন-ব্যাগ এমনকি সারা বৎসর ফ্রী টিউশনির ব্যবস্থা করতেন। পুজোর সময় গরিব মানুষদের বস্ত্র বিতরণ করতেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে মানুষের জন্য এভাবে ভাবা যায় না। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বহুমুখী প্রতিভার উন্মোচন করে চলেছেন দিনের-পর-দিন। মাস্টারদা মানব সেবার মন্ত্রে ব্রতী হয়েছেন চিরকাল।
গরিব মানুষগুলো যখন দুহাত তুলে মাষ্টারদাকে আশীর্বাদ করেন তখন মনে হয় ভগবানের কি বিচিত্র লীলা। খুব ভালো লাগে এটা ভেবে যে, এরকম একজন মহান মানবের আমিও একদিন ছাত্র ছিলাম। তিনি প্রায় আমাদের নানান স্মরণীয় ঘটনা বলতেন। বলতেন--- " মহান মনীষীদের জীবনকে জানো, কিভাবে নিজের জীবনকে তাঁরা অন্যের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন।" স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত তিনি। তাই সর্বদা মানুষের কথা ভাবতে পারেন। ঈশ্বর তাঁকে অনেক দিয়েছেন কিন্তু সেই সুখে তিনি অহংকারী নন। তিনি বলতেন --- "মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে বেশী কিছুর প্রয়োজন হয় না। বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। তাই তোমার উদ্বৃত্তটাকে গরিব-দীন মানুষের সেবায় লাগাও। দেখবে তুমি মহান জীবনের আনন্দ অনুভব করবে।"
আরো একটা কথা না বললে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেওয়া থেকে বঞ্চিত থাকতাম, সেটি হল-- তাঁর জ্ঞান ও অন্যকে বোঝানোর ক্ষমতা। তাঁর মধ্যে রয়েছে বইপাগল মানসিকতা। তিনি বই পড়তে এত ভালবাসেন যা বলে বোঝানো যাবে না। সংক্ষেপে তাঁকে বলা যায় 'বইপোকা'। কথায় আছে ভালো স্রষ্টা হতে গেলে আগে ভালো পাঠক হতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। সেই অভিজ্ঞতা সৃষ্টির পথে প্রেরণা দান করে। "দিয়া পাবলিকেশন" নামে একটি প্রকাশনী তৈরি করেছেন তিনি। সেখান থেকে সারা বছরে বিভিন্ন সাধের অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশ পায়। নিজের লেখা গ্রন্থও আছে তার মধ্যে। তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে একশোরও বেশী বই সম্পাদনা করেছেন তিনি। নিজের লেখা বই প্রকাশ করেছেন অনেক। "তবু একলব্য", "সন্ধান" ও "দিয়ার সাহিত্যচর্চা" নামের বিভিন্ন জার্নাল ও গবেষণাধর্মী বইয়ের বিভিন্ন সংখ্যা তাঁর প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। অসংখ্য লেখক-লেখিকা অধ্যাপক- অধ্যাপিকার লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে এই পত্রিকাগুলি। তিনি প্রায় বলতেন --- "মানুষ হয়ে জন্মেছ একটা দাগ কেটে যাও। প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখো। দেখবে লেখার প্রতি তোমার ভালোবাসা জন্মাবে।" সত্যিই মাস্টারদার এই কথাগুলি আমার জীবনে মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। আজকের মাস্টারদের সঙ্গে মাস্টারদার অনেক ফারাক। নিজের স্বার্থে সকলে এগিয়ে চলে, ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরি করার দায়িত্ব তাঁদের নেই। কিন্তু মাস্টারদা তাদের মধ্যে পড়ে না। তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে পথপ্রদর্শক ও আদর্শ।
_____________________________________________________________________________________
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা।
[ছবি: ইন্টারনেট মাধ্যম থেকে সংগৃহীত]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন