তাঁর নোবেলজয়ী গবেষণার পুরোটাই সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার Indian Association for the the Cultivation of Science ছোট্ট একটা গবেষণাগারে। ১৯২১ সালে Oxford University তে অনুষ্ঠিত হয় World University Congress. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে রমন সেখানে যোগ দেন। এটাই রমনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ।কয়েকদিনের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় থমসন, রাদারফোর্ড , ব্র্যাগ সহ আরো অনেক জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী।জাহাজে করে লন্ডনে আগমনের পথে, এই বিশাল সমুদ্রের অভিনব রূপ প্রত্যক্ষ করে বিস্ময়তা ও মুগ্ধতার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল রমনের জিজ্ঞাসু মনন। গভীর সমুদ্রের রং দেখে তাঁর অবচেতন মনে প্রশ্ন আসে এই ঘন নীল রংয়ের নিগূঢ় রহস্য কি? এর আগে লর্ড রেলেই আকাশের নীল রংয়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অনুর সাথে আলোক কনার বিক্ষেপণের ফলে নীল আলোক তরঙ্গ বেশি দেখা যায় বলেই দিনের বেলায় আকাশের রং নীল। সমুদ্রের নীল রং সম্পর্কে লর্ড রেলেইর তত্ত্ব বেশ সরল ,সাদামাটা। তাঁর মতে সমুদ্রের রং আসলে সমুদ্রের জলে আকাশের রংয়ের প্রতিফলন। রমন লর্ড রেলেইর এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করেন জাহাজে সফরকালে কয়েকটি সহজ পরীক্ষার সাহায্যে। একটি পোলারাইজিং প্রিজমের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের জল আকাশের প্রতিফলন আড়াল করার পরেও দেখা গেল সমুদ্রের জলের রং ঘন নীল-যেন জলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে নীল রং। পরীক্ষার ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সমুদ্রের জলের রং নীল আকাশের রংয়ের প্রতিফলন নয়, জলে আলোক কণার বিক্ষেপণের ফল। রমন সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা থেকে জল সংগ্রহ করে বোতল ভর্তি করে নিয়ে আসেন কলকাতায়।প্রিজম ,টেলিস্কোপ প্রভৃতির দ্বারা গভীর সমুদ্রে রঙের খেলা গভীর মনোনিবেশে পর্যবেক্ষণ করতে করতে নানান উপাত্ত সংগ্রহ করেন রমন। কলকাতায় প্রত্যাবর্তনে তরল পদার্থে এক্স-রে এবং দৃশ্যমান আলোকের বিক্ষেপণ সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই গবেষণার অনুপঙ্খ ধারাবাহিকতাতেই আবিষ্কৃত হয় সেই যুগান্তকারী বহু প্রত্যাশিত রমন ইফেক্ট। এক কথায় বলতে গেলে পদার্থের বিভিন্ন অনু পরমানুই সেই পদার্থের বর্ণের প্রতিফলনের জন্য দায়ী, তা সেই জল-মাটি আকাশ বা যা কিছুই হোক না কেন ।কোন বস্তুকে কি রঙের দেখাবে তা তার উপরই নির্ভরশীল। রমন ইফেক্ট আলোক তরঙ্গের অনেক অজানা দিক উন্মোচন করে দিয়েছে। শক্তিস্তর এবং অনু ও পরমাণুর গঠন উপলব্ধিতে প্রভূত সহায়ক হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের বহুবিধ শাখায় কাজে লাগানো ও প্রয়োগ করা হচ্ছে। জীব বিজ্ঞান, রসায়ন ,চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক শাখায় রমন ইফেক্টকে প্রয়োগ করে অনেক নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে।
১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সিভি রমনকে নাইট খেতাব দিলে নামের আগে স্যার যুক্ত হয়। স্যার সি ভি রমন দ্রুত হয়ে ওঠেন ভারতীয় বিজ্ঞানের জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি। সাধারণত বিজ্ঞানের যেকোনো আবিষ্কারের পর অনেক বছর লেগে যায় তার স্বীকৃতি পেতে। বিশেষত নোবেল পুরস্কার এর মতো পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে। ১৯৩০ শালী রমন ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন সি ভি রমন। পুরস্কারের প্রস্তাবক ছিলেন ১০ জন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে ছিলেন ৬ জুন নোবেল জয়ী-নীলস বোর ,রাদারফোর্ড ,ব্রয়লি, স্টার্ক চার্লস উইলসন ও মানে সিগবন। রমন যেন ইতিপূর্বেই জ্ঞাত ছিলেন যে তিনি নোবেল পুরস্কার পাবেন। ১৯২৪ সালের শেষে রয়াল সোসাইটির ফেলোশিপ পাওয়ার পর রমনকে যখন সম্বর্ধনা দেওয়া হয় -রমন বলেছিলেন" আশা করছি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ভারতের জন্য নোবেল পুরস্কার নিয়ে আসতে পারবো"। ঠিক ৫ বছর পরেই তাঁর নোবেল পুরস্কার লাভ।কেবল তাই নয়১৯২৫ সালে শিল্পপতি জিডি বিড়লার কাছে স্পেক্ট্রোগ্রাফ কেনার জন্য টাকা চেয়ে লেখা এক চিঠিতে তিনি লেখেন-" আমি যদি একটা যন্ত্র পাই ,তাহলে ভারতের জন্য নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারব"। এটাই ছিল বিজ্ঞানী সিভি রমনের অপার আত্মবিশ্বাস যেখানে বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার সঙ্গে কর্মমুখীন ও দূরদর্শী বাস্তবতা মিশে গেছে। তাঁর মূল্যবান আবিষ্কার ও সর্বোচ্চ সম্মান ভারতবর্ষকে জগত সভায় সৃষ্ট আসনে বসার সৌভাগ্য এনে দিয়েছিল এবং বিশ্বের বিজ্ঞানের মানচিত্রে ভারতের স্থান উজ্জ্বল করেছিল।
১৯৮৬ শালী জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা যোগাযোগ ভারত সরকারের কাছে ২৮শে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করে। পরে সরকার এই আবেদনের অনুমোদন দেয়।এটি সারা দেশব্যাপী বিভিন্ন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় ,অন্যান্য শিক্ষক ,বৈজ্ঞানিক, কারিগরি চিকিৎসা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এই দিবস পালিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে সচেতনতা প্রসারতা বাড়াতে দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার জন্য এবং নব প্রজন্মকে আরো বেশি বিজ্ঞানমনস্ক অনুরাগী করার জন্য এই দিনটি পালিত হয়।বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের জন্য নানারকম বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আমাদের সংবিধান অনুসারে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাস, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা যেমন আমাদের মৌলিক অধিকার ,তেমনি বিজ্ঞান চেতনা গড়ে তোলা মানবিকতা ও জ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করা আর হিংসাকে প্রতিরোধ করাও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমরা কিন্তু কুসংস্কার বিরোধীতাকে আমাদের সংস্কার করে তুলতে পারিনি?জ্যোতিষী ,ফকির সাধু,সন্তদের পাল্লায় পড়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে ধর্ষিত হচ্ছে খুনও হচ্ছে। সেই সব দেখি শুনেও আমরা সচেতন হইনি। ভারতরত্ন বিজ্ঞানী সিএন রাও বলেছেন" উপগ্রহ উৎক্ষেপণের আগে পঞ্জিতে শুভক্ষণ বিচার করা বা ভগবানের আশীর্বাদ চাওয়া স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়।"এই কথাটা অকপটে বলার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।কিন্তু এই উদাহরণ তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান চেতনাও শুধু পড়াশোনা কাজকর্মেই সীমাবদ্ধ।বিজ্ঞানচেতনা যে শুধু কিছু তথ্য ছবি আর চিহ্নমাত্র নয় আসলে একটা সংস্কৃতি যা জীবনের সর্বত্রই বজায় রেখে চলতে হয় যা কোন অযৌক্তিক ধারণাকেই প্রশ্রয় দেওয়া বিরোধী। সেটা আমাদের জীবনে সত্যি হয়ে ওঠেনি সেভাবে।তেমনি বিজ্ঞান দিবস মানে যে একদিন সচেতন হয়ে উঠি বাকি দিনগুলোতে চোখ বুজে থাকা নয় বরং এই কাজটাকেও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, সেটা বুঝতে আরো কতগুলো নরেন্দ্র দাভোলকর লাগবে কে জানে? আমরা বিজ্ঞানকে শুধুই ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির ল্যাবেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। এর বাইরে তার প্রচার, প্রসার নিয়ে আমরা চরম উদাসীন ও উন্নাসিক। বিজ্ঞান তো আলোর দিশারী।অন্ধকার যুগ থেকে এই আলোর যুগে বিজ্ঞানের হাত ধরেই তো আমরা এসেছি। প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করেছি জীবন ধারণ এবং গড়ার মন্ত্র। বিজ্ঞানই তো আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে সত্য ও মিথ্যার তফাৎ যুক্তি ও সঠিক প্রমাণের দ্বারা। তা নাহলে আজও আমরা সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরাতে থাকতাম। চিকিৎসাশাস্ত্র থেকেই অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান থেকে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ছাড়া পঙ্গু। .অন্যান্য বারের মতো এবছরও প্রথামাফিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালিত হচ্ছে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব বিজ্ঞান দিবস।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ,কর্মসূচি, প্রচারাভিযান গুলো কতটা বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য এবং কতটা জনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য সেটা ভাবা প্রচন্ড জরুরী। পরিশেষে আবারো সেই একটি কথা সকলের উদ্দেশ্যে -আজকের দিনটি হোক শুধুই বিজ্ঞানের জন্য। আমাদের সবার মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে বিজ্ঞান চিন্তায় অভ্যস্ত হতে হবে,নতুবা আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসরমান বিশ্বের সর্বশেষ অর্জন ও স্বীকৃতি গুলো সম্পর্কে জানতে বুঝতে পারব না ।আমাদের প্রজন্মরা ফলস্বরূপ পিছিয়ে পড়বে। চলুন আমরা সবাই দল মত নির্বিশেষে বিজ্ঞান কে ভালবেসে বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে ওঠে এবং দেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন